‘রাংগুই’ একটি আমের নাম। বান্দরবানের স্থানীয় ভাষায় এটি ‘বার্মিজ’ আম নামে পরিচিত। এ আম খেতে সুস্বাদু, তাই দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে। এছাড়া এ আমের দামও কম।
বর্তমানে বান্দরবানের লামা উপজেলায় এ আমে হাট-বাজারগুলো জমজমাট হয়ে উঠেছে। রাংগুই বা বার্মিজ আমের পাশাপাশি পাওয়া যাচ্ছে আম্রপালি, রূপালি, লেংড়াসহ কয়েক জাতের আম। এবারে এ উপজেলার ৫০০ হেক্টর জমিতে রাংগুই আম চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় বাম্পার ফলন হয়েছে এ আমের। তবে বাগান মালিকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
স্থানীয় বাজারে শুরুতেই প্রতি কেজি আমের খুচরা মূল্য ৬০-৭০ টাকা হারে বিক্রি হলেও বর্তমানে এ আম বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১৫-২০ টাকায়। অথচ গত বছর স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি আম ৪৫-৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। শুধু এতদ্বঞ্চলে নয়, এ আমটির কদর বাড়তে শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার আম চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। আমের বিকিকিনিকে কেন্দ্র করে পাল্টে যাচ্ছে এলাকার অর্থনীতি।
উপজেলার এমন কোনো বাড়ি নেই, যে বাড়িতে অন্তত ৮-১০টি আম গাছ নেই। শুধু তাই নয়, উপজেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতেও অন্তত দুই শতাধিক আম বাগান করেছে বিভিন্ন কোম্পানি ও স্থানীয়রা। চলতি মৌসুমে কয়েকটি জেলার পাইকাররা এখান থেকে প্রতিদিন কয়েকটন আম পাঠিয়ে দিচ্ছেন ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। এতে স্থানীয় ব্যবসায়ী, চাষী ও ভ্রাম্যমান ব্যবসায়ীরাও বেশ লাভবান হচ্ছেন।
উপজেলা বিভিন্ন ইউনিয়নের পাহাড়ে গেলে চোখে পড়বে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আমের বাগান। এখানকার মাটি আম চাষের সম্পূর্ণ উপযোগী হওয়ায় এলাকার চাষীরা অন্য ফসলের চেয়ে বর্তমানে আম চাষে সবচেয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
আম বাগান মালিক মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, ৫ একর পাহাড়ি জমিতে বার্মিজ আম বাগান তৈরি করেছেন তিনি। বাগানে প্রায় ৩০০টি আম গাছ রয়েছে। এসব গাছের বয়স প্রায় ৮-১০ বছর। চলতি বছর বাগান পরিচর্যায় প্রায় ২০ হাজার টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। যথাসময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বাড়তি পরিচর্যা করতে হয়েছে। সময়মতো বৃষ্টি হলে আমের ফলনও আরো বেশি হতো।
তিনি বলেন, ৪০টি গাছে প্রায় ১০০ মন আম ধরেছে। কেজি প্রতি ১৫ টাকা হারে গাছেই বিক্রি করে দিয়েছি।
আম চাষীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, প্রতিটি আমগাছ থেকে আম পাড়ার সময় এখন। সাম্প্রতিক সময় টানাবর্ষণে আমগুলোতে কিছুটা এক জাতীয় পোকার আক্রমণ করেছে। পোকার কামড়ে অধিকাংশ আম ফেটেও যাচ্ছে। এতে প্রচুর আম চাষীদেরকে ফেলে দিতে হচ্ছে। এতেও চাষীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।
আমের ফলন ভালো হওয়ায় ভোক্তা সাধারণ বেজায় খুশি। কারণ অল্প দামে তারা প্রচুর আম কিনতে পারছেন। এ এলাকায় ফরমালিনমুক্ত আম পাওয়া যায় বিধায় শহরের অধিকাংশ মানুষ মধু মাসের ফল কিনে নিয়ে যায়।
কয়েকজন চাষী আক্ষেপ করে বলেন, পার্বত্য এলাকায় যে পরিমাণ মৌসুমী ফল উৎপাদিত হয়, তা থেকে চাষীরা কাঙ্খিত মূল্য কখনো পায় না। কারণ হলো এসব মৌসুমী ফল সংরক্ষণের জন্য এ অঞ্চলে কোথাও কোনো হিমাগার নেই। তাই প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার মৌসুমী ফল নষ্ট এখানে। তারা সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতি হিমাগার স্থাপনের জোর দাবি জানান।
জসিম উদ্দিনের মতো ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি বাগান মালিক আপাই মারমা, মাকসুদুর রহমান মুক্তার, অরুণ তালুকদার, আব্দুর রশিদও চলতি বছর আম চাষ করে অনেকটা লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকার আম বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করেছেন।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে আসা পাইকার শাহজাহান আলী ও সামসুল জানান, প্রতি মৌসুমে আমরা উপজেলা থেকে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আম পাঠাই। এ উপজেলার বার্মিজ আম অন্যান্য জেলার আমের চেয়ে স্বাদে একদম আলাদা। তাই এখানকার আমের চাহিদাও অনেক। এছাড়া দাম অনেক কম ও কেজিতে ৬ থেকে ৮টি আম পাওয়া যায়। তাই ক্রেতারাও খুশি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী উচিং মার্মা, রশিদুল ও মকবুল হোসেন জানান, বাগানে ফল আসার আগেই আমরা আকার ভেদে স্থানীয় বাগান মালিকদের কাছ থেকে বাগানের ফল ক্রয় করি। বাগান রক্ষণাবেক্ষণে নিয়মিত ২০ থেকে ৫০ জন শ্রমিক প্রতিটি বাগানে কাজে লাগাতে হয়। এতে শ্রমিকদেরও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। আর বাগানের উৎপাদিত ফল বিক্রি করে আমরাও লাভবান।
স্থানীয় বাগান মালিক মংক্যচিং মার্মা, মোস্তফা, হারুন ও সুজন জানান, বাগানে মুকুল আসার আগেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এসে বাগান ক্রয় করেন। আমরাও বাগান রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পেরে আগেই বাগানের ফল বিক্রি করে দেই। এতে আমরা বেশ লাভবান হয়ে থাকি।
লামা বাজারের খুচরা আম বিক্রেতা উচিং মার্মা বলেন, তার স্বামী প্রুথোয়াই মার্মা শীলেরতুয়া এলাকার একটি বাগানের আম ক্রয় করেন। পরে গাছ থেকে আম সংগ্রহ করে দু’তিন দিন ঘরে রেখে দিলে তা পেকে যায়। তখন বাজারে খুচরায় বিক্রি করে দিই। বাজারে প্রতি কেজি আম ২০ টাকায় বিক্রি করছি।
এ বিষয়ে লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ নূরে আলম জানান, একটি পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নের প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে আমের ফলন হয়েছে। এ অঞ্চলের চাষীরা রাংগুই আম গাছের বাগান করে বেশ লাভবান হচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে এ আমের বেশ চাহিদা থাকায় প্রতি বছরেই নতুন নতুন আম বাগান গড়ে উঠছে।
পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা লাভবান ও শ্রমিকদেরও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে দাম কম হওয়ায় চাষীদের মুখে হাসি নেই বলেও জানান তিনি।
বিবার্তা/নুরুল/জাকিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]