নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেছেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের একটি কেন্দ্রেও অনিয়ম হবে না। এসময় তিনি প্রার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মতো রাজশাহীতেও অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একটি কেন্দ্রেও অনিয়ম হবে না। কেন্দ্র দখল করে ব্যালট ছিনতাইয়ের কোনো ঘটনাও ঘটবে না।
গতকাল বুধবার দুপুরে রাজশাহী সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডে অনুষ্ঠিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের সাথে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে নির্বাচন কমিশনার এসব কথা বলেন। এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পাঁচজন মেয়র প্রার্থী ও কাউন্সিলর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
নির্বাচন কমিশনার বলেন, ভোটের দিন যেসব অভিযোগ আমরা পেয়ে থেকে বিশেষ করে কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান, ব্যালট ছিনতাই ও কেন্দ্রের চারশো গজের মধ্যে প্রচারণা চালানো এর কোনোটিই যাতে না ঘটে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আশা করছি, আপনাদের সহযোগিতা পেলে রাজশাহীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এসময় নির্বাচন কমিশনার নগরীতে সাঁটানো পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন সাঁটানোয় আচরণ বিধি লঙ্ঘন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আচরণ বিধির সাথে সাংঘর্ষিক সব ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুন খুলে ফেলার নির্দেশ দেন।
এর আগে অনুষ্ঠিত সভায় মেয়র, সাধারণ ওয়ার্ড ও সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাদের বিভিন্ন অনুযোগ-অভিযোগ ও আশঙ্কার কথা নির্বাচন কমিশনারের কাছে তুলে ধরেন। এসময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই প্রার্থী পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেন।
এসময় অভিযোগ করে কাউন্সিলর প্রার্থীদের নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার, পেশি শক্তির ব্যবহার, ব্যালট পেপার ও ব্যালট বক্স নিয়ন্ত্রণ করার আহবান জানিয়েছেন। কেউ নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রার্থীদের প্রচারণার খরচ বহনের বিকল্প প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। কেউ পোস্টার সন্ত্রাস আবার কেউ ব্যানার ফেস্টুনের মাপের অসঙ্গতি তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতিকার চান। নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের কেউ কেউ ভোট সন্ত্রাস, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের আশঙ্কা করেছেন।
তবে সব অভিযোগ শুনে নির্বাচন কমিশনার নিজেদের শপথ রক্ষার অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে আগামি ৩০ জুলাই অবাধ, নিরপেক্ষ ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশ্বাস দেন।
বিভাগীয় কমিশনার নূর-উর-রহমানের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ। এসময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, নগর পুলিশের কমিশনার এ কে এম হাফিজ আখতার, র্যাব-৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহবুবুর রহমান, পুলিশ সুপার মো. শহীদুল্লাহ। পরিচালনা করেন, জেলা প্রশাসক এস এম আব্দুল কাদের।
মতবিনিময় সভার শুরুতেই সাধারণ ওয়ার্ড ও সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীদের কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়। এসময় ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের একজন কাউন্সিলর প্রার্থী অভিযোগ করে বলেন, আমার ওয়ার্ডে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে।
৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী কামরুজ্জামান কামু বলেন, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার কারণে রাজশাহীতে এখন নির্বাচনী আমেজ সৃষ্টি হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে নগরীতে। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানান তিনি। ব্যবসায়ীদের কালো টাকার ব্যবহার ও ধর্মের অপব্যবহারের প্রতি সজাগ থাকার আহ্বান জানান তিনি।
এসময় আরো অনেকেই কথা বলার জন্য হাত উঁচু করলেও মতবিনিময় সভার উপস্থাপক বলেন, যাদের হাতে স্লিপ দেয়া হয়েছে তারাই কথা বলবেন। সংরক্ষিত ওয়ার্ডের একজন নারী কাউন্সিলর বলেন, আমার প্রচারণায় বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ভয়ভীতি ও হুমকি দেয়া হচ্ছে। ভোটের সময় টাকার খেলার দিকে নির্বাচন কমিশনকে দৃষ্টি রাখতেও অনুরোধ করেন তিনি।
কাউন্সিলর প্রার্থী গুলশান আরা মমতা বলেন, আমরা চাই আমাদের ব্যালট পেপার হেফাজতে থাকুক। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অঙ্গীকার পূরণের আহ্বান জানান তিনি। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মিনা সুলতানা সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ বজায় রাখার আহ্বান জানান।
এরপর ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থী বলেছেন, প্রিজাইডিং অফিসার কারা হচ্ছে কোন জায়গা থেকে হচ্ছে আমরা জানতে চাই। কালো টাকা কোথা থেকে আসছে জানতে চাই। কাউন্সিলর প্রার্থীদের অভিযোগ উপস্থাপন শেষ হওয়ার পর মেয়র প্রার্থীদের পাঁচ মিনিট করে সময় দেয়া হয়।
প্রথমেই বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির কাঁঠাল প্রতীকের প্রার্থী হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, এখানেই নিজেকে নিরাপদ মনে করছি। বাইরে গেলেই অনিরাপদ। নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘণের সুযোগ না দিয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রার্থীদের প্রচারণার কাজ নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ করার দাবি জানান তিনি।
তিনি প্রচার-প্রচারণা প্রসঙ্গে বলেন, আপনারা অত্যন্ত নির্যাতনের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী। আমি সাধারণ ভোটারদের কাছে ভোট প্রার্থনা করবো। আমাকে দলবাজি করতে হবে কেন? এসময় তিনি মেয়রপ্রার্থী বুলবুলের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ জানান।
ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী শফিকুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, নির্বাচনের সময় আমরা বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। এখানে তো সমান অধিকার নিয়ে প্রচারণা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারি। তাই নির্বাচন উপলক্ষে সেনা বাহিনী মোতায়েন চাই। তিনি বলেন, গাজীপুর ও খুলনায় নির্বাচনের নামে ভোট ডাকাতি হয়েছে। ছিনতাই হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোটের অধিকার রক্ষা ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহবান জানান ইসলামী আন্দোলনের এই প্রার্থী।
হাতি মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী মুরাদ মোর্শেদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী কী সে বিষয় মনে করিয়ে দিয়ে বিভিন্ন প্রার্থীর ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারের মাপ নিয়ে বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরেন তিনি। তিনি ব্যালট বাক্সের স্বচ্ছতা, পোলিং এজেন্টদের নিরাপত্তা বিধান করার আহ্বান জানান।
বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, আমি নিজে তিনটি ইলেকশন করেছি। তিনটির প্রেক্ষাপট তিন রকম। প্রথমে ভয়ভীতি ছিল ২০০৮ সালে। ২০১৩ সালে নিরপেক্ষ ছিল, যার কারণে জয়ী হয়েছি। কিন্তু এবার রাজশাহীতে দেখছি পোস্টারের সন্ত্রাস। এতে রাজশাহীর সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। কালো টাকার দৌরাত্ম্য ও প্রশাসনের অতি উৎসাহী ব্যক্তিরা আমার পোস্টার ব্যনার ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, আজকে নির্বাচন নয় যুদ্ধের পরিস্থিতি চলছে রাজশাহীতে। পোলিং এজেন্টরা নির্ভয়ে যাবে কিন্তু বিগত দিনের কর্মকাণ্ডে সেই অবস্থা নেই। একজন প্রার্থীর পক্ষে মোটরসাইকেলে করে টাকা দিচ্ছেন। একটা ওয়ার্ডেই ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা খরচ করছেন।
তিনি নির্বাচন কমিশনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, প্রত্যেক পোলিং এজেন্টদের যদি নিরাপত্তা দিতে পারেন তাহলে আমরা ভোট করবো। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পর ধানের শীষের বিরুদ্ধে ৫ টি মামলা করা হয়েছে। বর্তমানে ১০০ জন নেতাকর্মীকে জেলে রাখা হয়েছে। আমি এখন কার ওপর ভরসা করবো? আমাকে ভরসার জায়গা দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, গত মঙ্গলবার সাগড়পাড়ায় বোমা হামলায় যারা জড়িত তাদের ধরা হোক, তাদের আইনের আইনের আওতায় আনা হোক। আমরা সন্দিহান ভোট করতে পারবো কি না?
তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন, যারা পাহারা দিবে তারাই যদি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন তাহলে আর কি হবে? তিনি নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্যে বলেছেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামি জাতীয় নির্বাচন কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে।
বক্তব্য প্রদানের সময়সীমা ৫ মিনিট নির্ধারণ করা হলেও ১০ মিনিট বক্তব্য দেন বুলবুল।
সর্বশেষ নৌকা প্রতীকের এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন তার বক্তব্যে বলেন, আমি একবার মাত্র কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। যারা আমার সাথে কাজ করেছেন তারা দেখেছেন, আমি শুরু থেকেই একই কথা বলে এসেছি। আমার সময়ে নগরভবনে কোন দলবাজি হয়নি, আগামিতেও নির্বাচিত হলে দলবাজি হবে না।
আমার প্রতিপক্ষ ভীতিকর পরিবেশের কথা বলে গেলেন, জানি না তিনি রাজশাহীবাসীকে ছোট করে গেলেন কি না। তিনি জিতে গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন আর হেরে গেলে চুরি ডাকাতির অভিযোগ তোলেন। এতে নাগরিকদের ছোট করা হয়। লিটন কালো টাকা ব্যবহারের বিরোধিতা করে বলেন, বিএনপি প্রার্থীর কাছে অনেক টাকা আসার কথা শোনা যাচ্ছে, কাজেই কালো টাকা তারাই নিয়েছেন।
তিনি বলেন, আমরা কিন্তু সবাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে আশ্বাসী। কারা বোমাবাজি করলো নির্বাচন কমিশনের কাছে আহ্বান করছি তাদের খুঁজে বের করুন। আমি জানি একটি গোষ্ঠী নির্বাচনের সুযোগে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও অপ্রীতিকর ও নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক। যারা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘণ করার চেষ্টা করছেন, যারা বিভিন্ন জায়গায় কালোটাকা ছড়াচ্ছেন, যারা সন্ত্রাস করার চেষ্টা করছেন তাদের বিরুদ্ধে তো মামলা হবেই। সবশেষে নির্বাচনে জয়-পরাজয় যাই ঘটুক না কেন তা মেনে নেয়ার আহবান জানিয়ে খায়রুজ্জামান লিটন তার বক্তব্য শেষ করেন।
বিবার্তা/তারেক/শারমিন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]