শিরোনাম
ফুটপাতে আশ্রয় নেয়া পরিবারটির ঠাঁই হলো কুড়িগ্রামে
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০১৮, ১৭:২৩
ফুটপাতে আশ্রয় নেয়া পরিবারটির ঠাঁই হলো কুড়িগ্রামে
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

ঢাকায় ওভারব্রিজে আশ্রয় নেয়া অসুস্থ্য নারী, তার স্বামী ও সন্তানদের অবশেষে ঠাঁই হলো কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নে। জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেখানে তাদের ঘর করে দেয়া হয়েছে।


শুক্রবার সকালে পরিবারটিকে সদর উপজেলার ইউএনও আমিন আল পারভেজ, এনডিসি সুদীপ্ত কুমার সিংহ এবং কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু তাদের পাঁচগাছি গ্রামে নিয়ে যান। এর আগে রাতের কোচে ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামে নেয়ার ব্যবস্থা করেন ঢাকাস্থ কুড়িগ্রাম সমিতির মহাসচিব সাদুল আবেদীন ডলার। সকাল সাড়ে ৭টায় পরিবারটি কুড়িগ্রাম শহরে পৌঁছালে তাদের কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে নেয়া হয়। সেখানে জীবনের কথা শোনান ফরিদা বেগম (৪০) ও তার স্বামী আনছার আলী (৬০)।


কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ইসলামপুর মৌজার মরাকাটি গ্রামে বাড়ি ছিল ফরিদার স্বামী আনছার আলীর। ছিল ২ একর ধানী জমি। দুধের ব্যবসা করে ভালোই চলছিল তাদের। চরের মধ্যে প্রতিদিন ২ মন করে দুধ সংগ্রহ করে ১৫ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে শহরের হোটেলগুলোতে দুধ সরবরাহ করতে তিনি। এভাবেই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু ব্রহ্মপূত্র নদের করাল গ্রাসে ২০১৬ সালে বাড়িঘর, আবাদি জমি সব হারিয়ে যায়। গৃহহীন হয়ে পরে পরিবারটি। তাদের সাথে আরও দেড়শ পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে ফেলেন। শেষে আশ্রয় মেলে ইসলামপুরে চাচাতো ভাইয়ের গোয়ালঘরে। সেখানে একমাস থাকার পর ঢাকায় চলে আসেন তারা।


'বাবা রে, অনেক কষ্টের জীবন মোর!' এমনিভাবে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আঞ্চলিক ভাষায় ফরিদা বেগম জানান, জন্মের আগেই তার বাবা মারা যান। জন্মের ৭ দিনের মাথায় তার মাও মারা যান। এতিম মেয়েটির কেউ দায়িত্ব নিতে চায়নি। ৫ বছর বয়সে তার নানি কুলসুম আর খালা তারামনি তাকে ছিন্নমুকুল নামক একটি এনজিওতে রেখে আসে। সেখানে ৭ বছর থাকার পর ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় এনজিওটি ভেঙে যায়। তারপর নানির কাছে ফিরে আসেন। কিছুদিন পরই তাকে বিয়ে দেয়া হয়। তিন মাসের মাথায় সেই সংসার ভেঙে যায়। তার দুই বছর পর আনছার আলীর সাথে তার বিয়ে হয়। সেটি ছিল আনছার আলীর দ্বিতীয় বিয়ে। তার প্রথম বউ ডায়রিয়া হয়ে মরে গিয়েছিল।


এই হলো ভাঙন কবলিত আনছার আলী আর ফরিদা বেগমের জীবনকাহিনী। অভাব-অনটন আর মাথা গোজার ঠাঁই না পেয়ে তারা গত নভেম্বরে ঢাকায় পাড়ি দেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে শেষে আশ্রয় নেন কলাবাগান ওভারব্রিজের নিচে; পলিথিন বিছিয়ে। সেখানে ধানমণ্ডি ক্লাবের দারোয়ান জামালের সহযোগিতায় মাঠের পাতা কোড়ানোর কাজ করে দিনে ২০০-২৫০ টাকা আয় হতো। তাই দিয়ে চলছিল মানবেতর জীবন যাপন।মাঝখানে কাজটাও বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় প্রায় না খেয়ে থাকতে হচ্ছিল পরিবারটিকে। সন্তানদের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ্য শরীর নিয়ে নিজেই ভিক্ষাবৃত্তি করতে বেড়িয়ে পরেন ফরিদা বেগম। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে আকলিমা (১১) (প্রতিবন্ধী) ও দ্বিতীয় কন্যা সন্তান আখিতারাকে (৭) তারা গ্রামের বাড়িতে চাচির কাছে রেখে এসেছিলেন। একমাত্র ছেলে ফরিদুল (সাড়ে ৩) তাদের কাছে থাকতো।


ফরিদা বেগম জানান, সেদিন দু'সন্তানকে নিয়ে কলাবাগান থেকে ল্যাবএইডের দিকে ভিক্ষা করতে বের হন। অসুস্থ্য শরীর নিয়ে বের হওয়ায় ফুটপাতেই পরে যান তিনি। দুই সন্তান না খেয়ে ছিল। মা হয়ে সইতে পারেননি। তাই ভিক্ষা করতে নেমেছিলেন অসুস্থ্য শরীর নিয়েই। ঘোরের মধ্যে তার মনে হচ্ছিল সেদিনই বুঝি তার শেষ দিন! বড় মেয়ে তাকে ধরে ছিল। ছোট ছেলে মাথায় পানি ঢালছিল। তারপর কী হলো কে জানে? পরেরে দিন লোকজন হাসপাতালে নিয়ে যায়।


সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যক ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে দুই সন্তানের মাতৃসেবার সেই ছবি। তা দেখে তাদের দায়িত্ব নেন কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন। সন্তানসহ পুরো পরিবারটিকে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে নেয় হলে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ঔষধ দেন সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম। এ সময় প্রাথমিকভাবে পরিবারটির খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তেল, লবনসহ সমস্ত উপকরণ সরবরাহ করেন কুড়িগ্রাম গণকমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম।



তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা কুড়িগ্রামের উন্নয়নে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছি। আমাদের ১২টি দাবির সাথে কুড়িগ্রামের সকল ভূমিহীনদের পূণর্বাসন চাই দাবিটি সংযুক্ত করছি।


কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু বলেন, বন্যা আর নদী ভাঙনে প্রতিবছর শত শত পরিবার ভিটা হারাচ্ছে। নদী তীরবর্তী উন্মুক্ত এলাকায় নদী শাসনের ব্যবস্থা না করায় বানভাসী ও গৃহহীনদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ফরিদার মতো হাজারও মানুষ এখন বড় বড় শহরের পথে ঘাটে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এসব মানুষদের পুনর্বসন জরুরি।


সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম জানান, নিয়মিত খাদ্য আর পুষ্টির অভাবে পুরো পরিবারটি স্বাস্থ্যহীনতায় ভুগছে। খাবার ও প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র পেলে আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।



কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিন আল পারভেজ জানান, জেলা প্রশাসনের নির্দেশে উপজেলা প্রশাসন এ পরিবারটিকে অস্থায়ীভাবে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা। জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীনের নির্দেশে তাঁদের তিন সন্তানকে স্কুলে ভর্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।


এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন জানান, সরকার প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের সকলের উচিৎ সরকারের এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়ানো। অসহায় ফরিদার পরিবারকে জমিসহ স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। একই সাথে করা হবে কর্মসংস্থানের।


বিবার্তা/সৌরভ/কামরুল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com