জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মার্চ-এপ্রিল দু’মাস মেঘনায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। নিষেধাজ্ঞার পর নদীতে মাছ শিকারে নেমেছে জেলেরা। সে নিষেধাজ্ঞার প্রায় দু’মাস কেটে গেলেও লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না রূপালী ইলিশ। ফলে হতাশ হয়ে পড়েছেন এখানকার জেলে ও আড়তদাররা।
দুশ্চিন্তায় পড়েছেন দাদনের টাকা আর ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে। অভয়াশ্রমের পর ইলিশ সমুদ্রে চলে গেছে, সেপ্টম্বর-অক্টোবর মাসে প্রচুর মাছ ধরা পড়বে বলে মনে করছেন মৎস্য কর্মকর্তারা।
সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়, মেঘনা নদীর বিভিন্ন স্থানে ডুব চরের কারণে অধিকাংশ মাছ সমুদ্রে চলে গেছে। তাই ভরা মৌসুমেও দিন-রাত জাল ফেলে ইলিশ না পাওয়ায় হতাশ জেলেরা। দৈনিক খরচের তুলনায় আয় না হওয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন জেলে পরিবারগুলো। তাছাড়া বিনিয়োগ করে লোকশান গুনছেন আড়তদার ও দাঁদন ব্যবসায়ীরা।
আরো জানা যায়, জেলা সদরের মজু চৌধুরীর হাট, রায়পুর উপজেলার মোল্লারহাট, হাজীমারা, চর ভৌরব, রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার, বগড়খেরী, কমলনগরের লুধুয়াঘাটসহ ৩০টি মাছঘাট রয়েছে এ জেলায়। এছাড়াও সরকারি ও ব্যাক্তি মালিকানায় রয়েছে অকেগুলো বরফ কল। নদীতে মাছ না পাওয়ায় উপকূলীয় এ জেলার প্রায় লক্ষাধিক জেলে ও সংশ্লিষ্ট সবাই অবসর সময় পার করছেন।
চর কাছিয়া এলাকার জেলে আবদুস সালাম বলেন, অভিযানের পর মেঘনা নদীতে এখন আর ইলিশ নেই। গতবছর এ সময় নদীতে দৈনিক ৮-১০ হাজার টাকার মাছ ধরা পড়তো। নৌকার খরচ আর দাঁদনের টাকা দিয়েও পকেটে টাকাও থাকতো। অথচ এখন তার উল্টোটা। কয়েকজন জেলে মিলে নদীতে গেলে নৌকার ইঞ্জিনের তেল ও খাবারে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত উল্টো খরচ যাচ্ছে। কিন্তু মাছ মিলছে না।
সাহেবের হাট এলাকার জেলে মুক্তার মাঝি ও রতন জানান, এক-একজন জেলে দাঁদন ব্যবসায়দের কাছ থেকে অগ্রিম এক-দেড় লাখ টাকা করে নিয়েছেন। মেঘনায় আশানুরূপ মাছ ধরা না পড়ায় তাদের মাঝে দেখা দিয়েছে এক ধরনের হাহাকার। দাঁদনের দেনা পরিশোধ না করতে পেরে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন তারা।
জেলার সবচেয়ে বড় মাছঘাট হচ্ছে কমলনগরের মতিরহাট বাজারে। এখানে ৪১টি বাক্সে প্রতিবছর প্রায় ১০ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়ে থাকে। কিন্তু এবার নদীতে মাছ কম পাওয়ায় আড়ৎদার ও দাঁদন ব্যবসায়ীরা খালি বাক্স নিয়ে বসে আছে জেলেদের অপেক্ষায়। অন্যদিকে জেলেরা ফিরছে ২/১ টি মাছ নিয়ে। কেউবা ফিরছেন শূন্য হাতে। ফলে ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, মতলব, শরীয়তপুর, ভৈরব, ভোলাসহ বিভিন্ন স্থানের জেলেদের অগ্রিম টাকা দিয়ে হতাশায় রয়েছেন তারা।
ওই ঘাটের আড়ৎদার আমজাদ হোসেন হান্নান জানান, নদীতে তার ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু এ ভরা মৌসুমেও নদীতে কাঙ্খিত ইলিশ পাচ্ছে না জেলেরা। এতে ব্যবসার চরমভাবে ক্ষতি হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ব্যাংকসহ বিভিন্ন ঋণের টাকা পরিশোধ নিয়ে।
অন্য এক আড়ৎদার ছায়েদুল হক বলি বলেন, আগে দৈনিক ৭-১০ হাজার টাকা লাভ থাকলেও এখন ২-৩ হাজারের বেশি হয় না। মনে হচ্ছে এ ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে অন্য ব্যবসায় করলে দ্বিগুন লাভ করা যেতো। অন্যদিকে জেলেদেরও চাপ প্রয়োগ করতে পারছি না টাকার জন্য, কারণ নদীতেই মাছ পাচ্ছে না তারা।
অপরদিকে মাছ না পাওয়ায় ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগত পাইকাররা। আলাপকালে ঢাকা কেরানীগঞ্জ থেকে আগত পাইকার মোস্তফা জানান, এবার গতবছরের ৪ ভাগের ১ ভাগ মাছও পাওয়া যায় না মেঘনা নদীতে। যে কয়টি পাওয়া যায় তারও দাম চড়া। এক কেজি পরিমাণের ইলিশ পাইকারি ২ হাজার থেকে ২২শ’ টাকা, এক কেজির বেশি হলে ২৫শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা, আবার ২ কেজির বেশি হলে ঘাটেই ৫ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হয়। এতে তারাও ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
এ ব্যাপারে মতিরহাট মাছঘাটের সভাপতি মেহেদী হাসান লিটন মেম্বার বলেন, ৪৫ বছরের পুরনো ও জেলার সবচেয়ে বড় এ মাছঘাটটি। প্রতিবছর ১১৫০ টাকা হারে ৪১টি মাছবাক্স ৪১ হাজার ১৫০ টাকা সরকারি ভ্যাট কৃষি বিপনী কেন্দ্রে জমা দিয়ে থাকে। তাছাড়া প্রতিবছর এ ঘাটে ইলিশের প্রায় ১০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। অথচ এবার নদীতে মাছের না থাকায় এক লাখ টাকাও ব্যবসা হচ্ছে না। বিনিয়োগ করে এখানকার ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম মহিব উল্যা জানান, একদিকে ডুব চরের কারণে নদীর ঘনত্ব কমে গেছে, অন্যদিকে এখনো পুরোপুরি ভরা মৌসুম হয়নি। অভয়াশ্রমের পর সব ইলিশ মাছ সমুদ্রের দিকে চলে গেছে। সে কারণে নদীতে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সেপ্টম্বর-অক্টোবর মাসে অন্ধারমানিকের সময় নদীতে প্রচুর পরিমানে ইলিশ পাওয়া যাবে।
বিবার্তা/ফরহাদ/জাকিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]