শিরোনাম
রমজানে নলছিটির মুড়ি পল্লীতে ব্যস্ততা
প্রকাশ : ২২ মে ২০১৮, ১২:৫১
রমজানে নলছিটির মুড়ি পল্লীতে ব্যস্ততা
আমিনুল ইসলাম, ঝালকাঠি
প্রিন্ট অ-অ+

রমজান মাস এলেই ব্যস্ততা বহুগুণে বাড়ে নলছিটি উপজেলার তিমিরকাঠীসহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের মুড়ি পল্লীতে। এসব গ্রামের শতাধিক পরিবার যুক্ত মুড়ি ভাজা ও তা বিক্রির কাজে। যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় তারা এ কাজ করছেন।


রমজানে কাজের চাপ বাড়ায় শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সকলেই মুড়ি ভাজার কাজে সাহায্য করে। টার্গেট থাকে রমজানের আগেভাগেই মুড়ি ভেজে মজুদ করা ও পাইকারের কাছে বিক্রি করা। উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নের তিমিরকাঠী গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে সকলেই মুড়ি ভাজা নিয়ে ব্যস্ত। মাটির হাঁড়ি পাতিলের টুং-টাং শব্দ চারদিকে। কেউ মুড়ি ভাজছে, কেউ তা বস্তায় ভরছে।


হাজারো মানুষের কর্মযজ্ঞের মধ্যদিয়ে হাতে ভাজা এ মুড়ি শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয় সারা দেশের রোজাদারদের কাছে ইফতারির প্রধান রসদ। তিমিরকাঠী গ্রামের দেড়শতাধিক পরিবার মুড়ি ভাজা পেশার সাথে জড়িত। একেকটি পরিবার প্রতিদিন কমপক্ষে এক মণ চালের মুড়ি ভাজতে পারে।


তিমিরকাঠী গ্রামের প্রায় পরিবারে দেখা যায় একই চিত্র। সেখানকার কলবাড়ি ও হাজি বাড়ির প্রায় অর্ধশত পরিবার মুড়ি ভাজার কাজে ব্যস্ত। এই গ্রামের বাসিন্দারা জানান, রমজান মাসকে কেন্দ্র করে গত সপ্তাহ থেকে দৈনিক হাজার মণ মুড়ি সরবরাহ করা হচ্ছে। পুরো রমজান মাসেই এ চাহিদা থাকে বলে জানান গ্রামবাসীরা। ইউরিয়া সারের ব্যবহারবিহীন হাতে ভাজা এ মুড়ি স্বাদে অতুলনীয়। তাই দিনে দিনে মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে এ মুড়ি।



তিমিরিকাঠী গ্রামের মোছেদ হাওলাদার জানান, এক সময় দেশের অন্য দশটা গ্রামের মতোই এ গ্রামের গৃহস্থরা নিজেদের পরিবারের প্রয়োজনীয় মুড়ি ভাজতেন। ১৯৪৮ সালে পার্শ্ববর্তী গ্রাম জুরকাঠির বাসিন্দা আমজেদ মুড়ি ভেজে তা বাজারে বিক্রি করতে শুরু করেন। তার দেখাদেখি তিমিরকাঠীর আরো কয়েকটি পরিবার তাদের সংসারের আয় বাড়াতে মুড়ি ভেজে বিক্রি শুরু করে। গ্রামের বেশ কিছু মানুষ মুড়ি ভেজেই তাদের সংসার চালাতে শুরু করে।


আশির দশকে আব্দুল হক নামের এক শিক্ষক বিভিন্ন স্থানের পাইকারদের মুড়ি ক্রয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করে এ গ্রামে নিয়ে আসেন। এরপরই কদর বাড়তে থাকে তিমিরকাঠী গ্রামের মুড়ির।


স্থানীয়রা জানায়, মুড়ির জন্য উপযোগী বিশেষ তিনটি প্রজাতির ধান ফলে দপদপিয়া ইউনিয়নের আশেপাশের এলাকাতে। বিশেষ করে এখানে মোটা, নখুচি সাদামোটা নামের তিন প্রজাতির ধানের ব্যাপক ফলন হয়। আগে শুধুমাত্র বউরি ধানের মুড়ির প্রচলন থাকলেও এখন তার চেয়েও সরস ধান হিসেবে নখুচি ধানের মুড়ির কদর বেড়েছে। এছাড়াও দিনাজপুর থেকে নম্বর-১৬ এবং ভারতের নলটি চাল ক্রয় করে নানান জাতের ধান দিয়ে গ্রামবাসীরা মুড়ি তৈরি করেন।


বাণিজ্যিকভাবে মুড়ি ভাজার সাথে তিন যুগ ধরে জড়িত তিমিরিকাঠীর ভূইয়া বাড়ির ৪০টি ঘরের সবাই। উনুনের জ্বালের কাছে থাকতে হয় বলে দুজন অথবা চারজন শ্রমিক পালা করে বিশ্রাম নিয়ে অবিরাম মুড়ি ভেজে যাচ্ছেন। শ্রমিকরা বিশ্রাম নিলেও মুড়ির চুলার কোনো বিশ্রাম নেই। দৈনিক গড়ে ৫০ কেজি মুড়ি ভাজতে পারলে খরচ বাদ দিয়ে পাঁচ থেকে ছয়শ’ টাকা লাভ হয়।


তবে নিজেরা ধান কিনে মুড়ি ভেজে শহরে নিয়ে বিক্রি করলে আরো দ্বিগুণ লাভ হয়। তাই স্বল্প পুঁজির মানুষ রমজান মাসে মুড়ি ভেজে কমপক্ষে ২৫ হাজার ও বড় পরিবারগুলো ৪৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন। পাইকাররা প্রতিকেজি মুড়ি ৮০ টাকা দরে ক্রয় করলেও খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা।


ফাইল ছবি


মুড়ি ভাজায় ব্যস্ত ভরতকাঠি গ্রামের আলিম হাওলাদার (৬০) জানান, পরিবারের সকলে মিলে তারা মুড়ি ভেজে সংসারের ব্যয় মিটান। পরিবারের নারী সদস্যরা বাড়িতে বসে মুড়ি ভেজে দেয় এবং পুরুষ সদস্যরা মুড়ি ভাজার কাজে সাহায্য করার পাশাপাশি ধান ক্রয় ও মুড়ি নিয়ে বাজারে বিক্রি করে বেশ ভালই আছেন।


গ্রামের পুরুষরা মুড়ি ভাজা শেষ হলে চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গেলেও নারীদের কোনো বিশ্রাম নেই। মুড়ি ভাজা শেষে ছেলে-মেয়ের দেখাশোনা ও রান্না-বান্না করে সংসারের যাবতীয় কাজ সারতে হয়। বলতে গেলে ২৪ ঘন্টাই এখন নারীদের ব্যস্ত থাকতে হয়।


মুড়ি ভাজার সাথে যুক্ত মুকুল বেগম জানান, সামান্য একটু ঘুমের সময় পাই বাকিটা মুড়ি ভাজা ও সংসারের কাজ করতে পার হয়।


স্থানীয় আড়তদাররা এ গ্রাম থেকে মুড়ি সংগ্রহ করে তা ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, চাঁদপুর, ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের হাতে তুলে দেন। একেকজন পাইকার এ গ্রামে অতিরিক্ত লাভের আশায় দাদন দেন পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা। তারাও মূলধনের পাশাপাশি লাভের অংশটি বুঝে নেন এ রমজান মাসে।


বিবার্তা/আমিনুল/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com