বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলায় উৎপাদিত তামাক বিক্রি করার পর শেষ হাসি হাসতে পারেনি চাষীরা। তামাক কোম্পানিগুলোর গুটি কয়েক কর্মকর্তা, কর্মচারীর অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতিই এরজন্য দায়ী বলে অভিযোগ ওঠেছে। এতে কৃষকের পরিবর্তে লাভবান হয়েছে এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী।
কোম্পানিগুলোর গ্রেড প্রতারণা, ওজনে কারচুপিসহ নানা ছলচাতুরীর কারণে উৎপাদিত তামাকের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে প্রায়ই ঘটেছে অপ্রীতিকর ঘটনা। ইতোমধ্যে কোম্পানিগুলো তামাক বিক্রি বন্ধ করে দেয়ায় চাষীদের ঘরে থাকা তামাক বাধ্য হয়ে কম দামে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে।
এতে করে ভিটে বাড়ি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে হবে বলে চাষীরা জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, গত তিন যুগের বেশি সময় ধরে লামা ও আলীকদম উপজেলার ফসলি জমিতে বিষবৃক্ষ তামাক চাষ হয়ে আসছে। দেশের বিভিন্ন তামাক কোম্পানির স্থানীয় কর্মকর্তাদের লোভনীয় ডাকে কৃষকেরা ধান ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন না করে তামাক চাষ করে থাকে কৃষকরা।
চলতি মৌসুমে বিভিন্ন কোম্পানির আওতায় ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি বাংলাদেশ, ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানি, আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানিসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির সহযোগিতায় উপজেলা দুটির প্রায় ১০ হাজার একর ফসলি জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।
চাষীরা বছরের অক্টোবর মাস থেকে এ তামাক চাষ শুরু করেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রায় ৭ মাস হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তামাক উৎপাদন ও প্রক্রিয়জাতকরণ শেষে এপ্রিল-মে মাসে বিক্রি শুরু করে। তামাক কোম্পানিগুলো তামাক কিনতে উপজেলা শহরসহ ইউনিয়নগুলোর বিভিন্ন স্থানে ক্রয় কেন্দ্রও স্থাপন করে।
তামাক চাষী স্বার্থ রক্ষা কমিটির সভাপতি শাহজাহান অভিযোগ করে বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো চলতি মৌসুমে নানান ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে তামাক চাষীদের ঠকিয়েছে। তাদের অনিয়ম, প্রতারণা ও স্বজনপ্রীতির কারণে চাষীদের লভ্যাংশ চলে গেছে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের পকেটে। প্রতি বেল তামাকে ব্যবহারিত চট বাবদ বিগত বছরগুলোতে সর্বোচ্চ ২ কেজি বাদ দেয়া হলেও চলতি মৌসুমে ৪ কেজি, কোথাও কোথাও আরো বেশিও বাদ দেয়া হয়েছে। প্রতি কেজি ১নং গ্রেডের তামাক চলতি মৌসুমে ১৫৭ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সে হিসেবে একজন চাষীর অনেক ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, এছাড়া কোম্পানির লোকজন নিজেদের ইচ্ছামত গ্রেডিং করেছেন। একই ধরনের তামাক কোনো পরিচিত চাষী থেকে স্বজনপ্রীতি দেখিয়ে ক্রয় করেছেন, আবার অন্য চাষীর ক্ষেত্রে নিম্নমানের বলে বাদ দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, প্রতি একর তামাক চাষে ৮শ’ থেকে ১ হাজার কেজি তামাক উৎপাদন হয়ে থাকে। এ তামাক প্রক্রিয়াজাত শেষে বিভিন্ন কারণে ২-৩ বেল তামাক সাধারণত একটু কালো রংয়ের হয়ে থাকে। এগুলো ক্রয় অযোগ্য বলে কোম্পানিগুলো চাষীদের থেকে কেনে না। যার কারণে বাধ্য হয়ে চাষীরা এক শ্রেণির মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের নিকট নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়।
পরবর্তীতে ওই তামাকই কোম্পানির কিছু কিছু কর্মকর্তা নিজেদের পছন্দনীয় মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের নিকট থেকে কিনে থাকেন। কালো রংয়ের তামাক বিক্রি করতে না পারার কারণে চাষীদের লভ্যাংশ মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের পকেটে চলে যাচ্ছে আর চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এদিকে চাষীরা তামাক কোম্পানিগুলোর এ সকল অনিয়মের প্রতিবাদ করায় ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর গজালিয়া এবং লামা লাইনঝিরি এলাকায় তামাক বিক্রয় কেন্দ্রে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। যা পরবর্তীতে পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সমাধান করেন।
তামাক ক্রয় কেন্দ্রগুলো সরজমিন পরিদর্শনে গেলে- চাষী আব্দুর শুক্কুর, হাসিনুর ও কেমাচিং মার্মাসহ আরো অনেকে তামাক কোম্পানিগুলোর এ অনিয়মের কথা তুলে ধরেন। এ সময় তারা বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো পাতার রং এক দিকে যেমন একটু কালো হলে ক্রয় করে না, অন্য দিকে ১২ বেলের বেশি হলেও তামাক কিনে না। এর ফলে চাষীরা বড় ধরনের লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন। এতে চাষীদের ভিটেবাড়ি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।
অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানির ডিপো ম্যানেজার সানাউল্লাহ সিকদার চাষীদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কোনো ধরনের মধ্য স্বত্ত্বভোগীদের সুযোগ দেয়া হয়নি। প্রকৃত চাষীদের থেকেই তামাক ক্রয় করা হয়েছে। তবে যে তামাকের রং একেবারে কালো এবং ঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত হয় নাই, সেগুলো কেনা সম্ভব নয়।
লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ নূরে আলম বলেন, বর্তমান সরকার কৃষিবান্ধব সরকার। কৃষকদেরকে সার, বীজসহ নানান ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। আমরা বিভিন্নভাবে কৃষকদেরকে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করে আসছি। তারপরও তারা তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলোভনে অধিক লাভের আশায় তামাক চাষ করছে।
সরকারি কোনো নির্দেশনা না থাকায় তামাক বিক্রয়কালীন সময়ে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের মনিটরিং করা হয় না বলেও জানান তিনি।
বিবার্তা/নুরুল/জাকিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]