চলতি বোরো মৌসুমে ধান কাটার উৎসব চলছে মৌলভীবাজারে। অনেক কৃষক আবার ধান কাটা শেষও করেছেন। তবে ভরা বোরো মৌসুমে বজ্রপাতের ভয়, আগাম বন্যার আশংকা এবং শ্রমিক সংকটে বিপাকে বোরো চাষীরা। সেই সাথে ব্লাষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে ২৫ শতাংশ ধানের ভিতরে নেই কোনো চাল।
তাই এখন ত্রিমুখী ভয়, আশংকা আর সংকটে কৃষকের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাজ।
মৌলভীবাজারের বিভিন্ন হাওরাঞ্চলে তড়িৎ গতিতে চলছে বোরো ফসল ঘরে তোলার আয়োজন। কৃষক মাঠ থেকে ধান কেটে নিয়ে আসছে, মাড়াই করছে, ধান শুকাতে ব্যস্ত কৃষাণীরা। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত, ছত্রাক জনিত ব্লাস্ট ও শ্রমিক সংকটের কারণে দুঃচিন্তার অন্ত নেই কৃষকদের।
গতবছর বন্যায় ব্যাপক ফসলহানির পর এবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন জেলার কৃষক পরিবারগুলো। গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে এ বছর জেলার হাকালুকি, কাউয়াদিঘী, কেওলার হাওরপাড়সহ অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকরা বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে চাষও করেছেন বোরো ধান।
তবে এরই মধ্যে তারা পড়ছেন নানান সংকটে। ধান কাটার আগে যে স্বপ্ন ছিল তা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে ধান তোলার সাথে সাথে। ব্লাষ্টে আক্রান্ত হয়ে অনেক কৃষকের ৫০ ভাগ পর্যন্ত ফসল নষ্ট হয়েছে। সেই সাথে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় রয়েছে বন্যার আশংকা। তার উপর এই বছর জেলা জুড়ে রয়েছে প্রচুর শ্রমিক সংকট। একেতো শ্রমিক সংকট তার উপর বজ্রপাতের ভয়ে শ্রমিকরা মাঠে যেতে না চাওয়ায় সংকট আরো তীব্র হচ্ছে।
জেলা কৃষি অফিসের দেয়া তথ্যানুযায়ী, মৌলভীবাজার জেলায় চলতি বোরো মৌসুমে ৫৪ হাজার ১২ হেক্টর জমিতে বোরো ফসলের আবাদ হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ হাজার হেক্টর বেশি। বোরোর এই বাম্পার ফলনে কৃষকরা আনন্দিত হয়েছিলেন। কিন্তু ধান তোলার সাথে সাথে হতাশা বাড়ছে তাদের।
জেলার বিভিন্ন হাওরাঞ্চলের দরিদ্র কৃষকরা এবারের বোরো ফসল নিয়ে আশাবাদী হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের আশা ধরে রাখতে পারছেন না। যে পরিমাণ জমি চাষ করেছেন কোথাও কোথাও তার অর্ধেকই ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত। যার ফলে ফসল অনেক কমে যাবে। ফসল ফলাতে যে খরচ হয়েছে সে টাকাও আসবে না। হাওরের সব ধান এখনো না পাকলেও ভয় ও আতংকে কাঁচা-পাকা ধান কেটে নিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। গত কয়েকদিন ধরে অবিরাম ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাতে আতঙ্কিত কৃষক, ঝড়ের সময় বজ্রপাতের ভয়ে মাঠে যেতে পারছেন না, আবার অতিবৃষ্টির ফলে যদি ধান তলিয়ে যায় সেই শংকাও কাজ করে। একসাথে সর্বত্র ধান কাটা শুরু হওয়ায় দেখা দিয়েছে শ্রমিক সংকট, বেশি মজুরী দিয়েও শ্রমিক মিলছে না।
শনিবার সরেজমিনে জেলার কাউয়াদিঘী হাওরে ঘুরে আইনুল মিয়া, জুসনা বেগম, অনিল দাস, মোহন্তা দাসসহ কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা হয় বিবার্তার এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, রোদ-বৃষ্টি-বজ্রপাতকে উপেক্ষা করে তারা সারাদিন হাওরে ধান কেটে নিয়ে আসছেন। সেই ধান মাড়াই দিয়ে গড়ে ২৫ শতাংশ ধানে চিটা পাচ্ছেন।
ধান কাটার পূর্ব মুহূর্তে ব্লাষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে ধান নষ্ট হয়েছে জানিয়ে তারা বলেন, এবার একটু ভালো ফসল পাওয়ার আশা ছিলো তা আর হবে না। এবার বন্যা না হলেও ব্লাস্ট রোগে মরে গেছে ধান। এই ধান দিয়ে সারা বছর চলতে হয়। খাওয়া-চিকিৎসা-লেখাপড়া সব এই ধান থেকেই হয়।
অন্যদিকে মৌলভীবাজার জেলার সব চেয়ে বড় বোরো ধানের ভান্ডার হাকালুকি হাওরে ব্লাষ্টের সাথে যোগ হয়েছে বন্যা আতংক।
এ বছর হাকালুকি হাওরের কুলাউড়া উপজেলা অংশে চার হাজার ৫৮০ হেক্টর, জুড়ী উপজেলায় চার হাজার ৯০০ হেক্টর, বড়লেখা উপজেলায় দুই হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে।
গত বছরের আগাম বন্যায় ফসল হারিয়েছেন হাকালুকি পাড়ের অধিকাংশ কৃষক। এ বছর বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে তবে ব্লাষ্টে ধান নষ্ট হওয়া ও বৃষ্টি শুরু হওয়ায় এবং আবহাওয়া অধিদফতরের বৃষ্টির পূর্বাভাসে কৃষকের কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে। ভারতীয় পাহাড়ি অঞ্চলের পানিতে হাকালুকি হাওর প্লাবিত হয় প্রতি বছর। ভারতের মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরার আবহাওয়া অফিসের বার্তায় বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয়ায় হাকালুকি পাড়ের কৃষকরা চাইছেন যত দ্রুতসম্ভব ফসল কেটে ঘরে তুলতে। কিন্তু বৃষ্টি এবং শ্রমিক সংকটের কারণে তা সম্ভব হচ্ছেনা। তার উপর বজ্রপাতের ভয়ে কেউ মাঠে যেতে সাহসও পাচ্ছেন না। যারা যাচ্ছেন তারাও মৃত্যুভয় নিয়েই যাচ্ছেন।
সরেজমিনে গেলে হাকালুকি হাওরপাড়ের ভুকশিমইল ইউনিয়নের কৃষক মাসুক মিয়া বিবার্তাকে জানান, গত বছরের অকাল বন্যায় তলিয়ে গেছে হাওর পাড়ের কৃষকদের শতভাগ বোরো ধান। এই বছর আমাদের ঘুরে দাঁড়াবার যে সম্ভাবনা ছিল তা শেষ পর্যন্ত কতটুকু হবে আল্লাহ্ জানেন।
অন্যদিকে সদর উপজেলার খাঞ্জার হাওরের কৃষক সেলিম মিয়া বিবার্তাকে জানান, কোদালিছড়া খনন করার বিগত কয়েক বছরের পর এ বছর ফসল তলিয়ে যায়নি তবে প্রতিদিনের বৃষ্টিতে বজ্রপাতের ভয়ে মাঠে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। সেই সাথে শ্রমিক সংকটও প্রচুর।
মৌলভীবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক শাজাহান বিবার্তাকে জানান, আবহাওয়া কয়েকটা দিন ভাল থাকলে ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। ব্লাষ্টের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন কিছু জায়গা থেকে অভিযোগ এসেছিল তবে আমরা সাথে সাথে পদক্ষেপ নেয়ায় খুব বেশি ক্ষতি হয়নি।
বিবার্তা/আরিফ/সোহান
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]