শিরোনাম
রশিদ গ্রুপের এমডির বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০১৮, ২২:১০
রশিদ গ্রুপের এমডির বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ
নাটোর প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গড়মাটিতে অবস্থিত ‘রশিদ অটোমেটিক রাইস মিল’ জঙ্গিদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন ইউনিটের জঙ্গিদের অর্থের যোগানসহ যাবতীয় সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে মিলের মালিক (এমডি) আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে।


রশিদ গ্রুপের মালিক আবদুর রশিদ কুষ্টিয়া জেলার পোরাদহ রেলস্টেশন সংলগ্ন বাজার এলাকার মৃত হাজী ইসাহক আলীর ছেলে। আবদুর রশিদের পোরাদহ বাজারে ‘মাতৃছায়া’ নামের ৪ তলার একটি বাড়ি রয়েছে। তবে কুষ্টিয়া পৌরসভার গুশাইপাড়া এলাকায় অন্য একটি বাড়িতে তিনি বেশি থাকেন।


সূত্র জানায় আবদুর রশিদের ৪টি বড় ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। এগুলো হলো- কুষ্টিয়া খাজানগর চালকল মোকাম এলাকার আইলচারায় রশিদ অ্যাগ্রো ফুড, পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার দাশুড়িয়ায় অবস্থিত রশিদ অয়েল মিল, রশিদ পেপার মিল (নির্মাণাধীন) এবং নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গড়মাটিতে অবস্থিত রশিদ অটোমেটিক রাইস মিল।


কুষ্টিয়া জেলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক এক চেয়ারম্যান জানান- কুষ্টিয়ার খাজানগরে রশিদ এগ্রো ফুড ইন্ড্রাস্ট্রিতে আত্মগোপন করে থাকা তৎকালীন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শুরা কমিটির প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে 'বাংলা ভাই'কে গ্রেফতার করতে যৌথ বাহিনী অভিযান পরিচালনা করেছিল। তথ্য সঠিক থাকলেও সফল হয়নি যৌথ বাহিনী।
খাজানগরে রশিদ এগ্রো ফুড ইন্ড্রাস্ট্রি থেকে মাথায় মাথাল ও কাস্তে হাতে কৃষকের বেশে বাংলা ভাইসহ তার সহযোগীদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করাসহ মোটা অংকের আর্থিক সহায়তাও করেছিলেন দেশের চাল সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা আবদুর রশিদ। পরে ২০০৬ সালের ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে বাংলা ভাই গ্রেফতার হয়।


অনুসন্ধানে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে আবদুর রশিদের ব্যবসায়িক প্রয়োজনের অজুহাতে অসংখ্যবার সৌদি আরব, ইরাক, সিরিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের সাথে গোপন বৈঠক করেছেন। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র বিভিন্ন গ্রুপকে জঙ্গিবাদের জন্য অস্ত্র ও অর্থ যোগানোর অভিযোগের তীর আবদুর রশিদের দিকে ছুড়ছেন কুষ্টিয়ার অনেকেই। অস্ত্র ও বিস্ফোরক কেনার জন্যও নাকি জঙ্গি সংগঠনকে অর্থ যোগানোর পাশাপাশি জেএমবির সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন বলেও জানা যায়।


বড়াইগ্রামের রশিদ অটোমেটিক রাইস মিলে যেসব শ্রমিক ও কর্মচারী আছে, তাদের বেশিরভাগ কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মোস্ট ওয়ান্টেড। হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার পলাতক আসামিও আশ্রয় নিয়েছে রশিদ গ্রুপের বিভিন্ন ইন্ড্রাস্ট্রিতে।


উল্লেখ্য এদের বেশির ভাগই জামায়াত, বিএনপি ও জঙ্গি সমর্থিত এবং বহু মামলার আসামি। যারা ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে রাস্তার গাছ কেটে অবরোধ করেছে, পেট্রোল বোমা হামলা করে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। তাদের আর্থিক সহায়তাসহ পুরস্কার হিসেবে আবদুর রশিদ দিয়েছেন কুষ্টিয়া,পাবনা অথবা নাটোরের রশিদ গ্রুপে চাকরি।


গতবছর যখন সারাদেশে চালের দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়েছিল, তখন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রশিদ অ্যাগ্রো ফুডের কারখানায় অভিযান চালিয়েছিল জেলা প্রশাসন ও পুলিশ। রশিদের কারণেই চালের দাম বাড়ছিল বলে সে সময় মন্ত্রীরা অভিযোগ করেছিলেন। সেই রশিদকেই এবার নতুন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি রশিদ অটোমেটিক রাইস মিলকে ১ লাখ টন চাল আমদানি করে দেয়ার কাজ দিয়েছে সরকার। সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ক্রয় কমিটির বৈঠকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।


মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দরপত্রে অংশ নিয়েই রশিদ অটোমেটিক রাইস সরকারি গুদামে চাল সরবরাহের কাজ পেয়েছে। তিনটি প্যাকেজে এ চাল কেনায় সরকারের খরচ হবে ৪২২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।


তথ্য আছে, রশিদ অটোমেটিক রাইস মিল ১ লাখ টন আমদানি করবে ভারত থেকে। ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান পিইসির সঙ্গে গত বছরের জুলাইয়ে চাল আমদানির বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশ ৫ লাখ টন চাল কিনতে চাইলেও ভারতের প্রতিষ্ঠানটি ২ লাখ টন চাল বিক্রি করতে রাজি হয়। চালের সরকারি মজুত খুবই কম থাকায় চলতি অর্থবছরে ১৫ লাখ টন চাল এবং ৫ লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।


২০১৭ সালে গুদামে অতিরিক্ত চাল মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগে বাংলাদেশ রাইস মিল অ্যাসেসিয়েশনের চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদকে তৎকালিন সময়ে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। কুষ্টিয়ায় আবদুর রশিদের ১৩টি গোডাউনে মাসের পর মাস বিপুল পরিমাণ চাল মজুদ থাকার অভিযোগ করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। গ্রেফতারের নির্দেশ আসার পর সেই সময়ে আব্দুর রশিদকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনি দেশের বাইরে গা ঢাকা দিয়েছিলেন।


কুষ্টিয়ায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের বৃহত্তম চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুর রশিদের মালিকানাধীন গোডাউনে বিপুল পরিমাণ ধান মজুদের অভিযোগ বরাবরই আছে। গতবছরও বেশি দামে চাল বিক্রির অভিযোগে তার চাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রশিদ অ্যাগ্রোকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।



সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান ও পুলিশ সুপার এসএম মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ রশিদ অ্যাগ্রো ফুড লিমিটেডে অভিযান চালায়।


জানা যায়, খাজানগর চালকল মোকাম এলাকার আইলচারায় রশিদ অ্যাগ্রো ফুডের চারটি স্বয়ংক্রিয় চালকল ও অফিসে প্রতিদিন ৫০০ টন চাল উৎপাদিত হয়। যাতে ধান লাগে ৮০০ মেট্রিক টন।


২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত আব্দুর রশিদের মিলের ১৩টি গোডাউনে অভিযান চালায়। অভিযান শেষে কর্মকর্তারা জানান, এসব গোডাউনে হাজার হাজার বস্তা ধান মজুদ করে রাখা হয়েছে। কতদিন আগে এসব ধান কেনা হয়েছে তা মিলের কর্মকর্তারা জানাতে পারেননি। ‘চার থেকে পাঁচ মাস বা তারও বেশি সময় আগে এসব ধান কিনে গোডাউনে রাখা হয়েছিলো। আব্দুর রশিদের একেকটি গোডাউনে তিন থেকে চার হাজার বস্তা পর্যন্ত ধান মজুদ ছিলো। আর প্রতি বস্তায় ৭১ কেজি করে ধান ছিলো।


অভিযোগ রয়েছে দেশের চাল সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি কুষ্টিয়ার আলোচিত চাল ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদসহ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ধান সংকটের ধুয়ো তুলে দফায় দফায় চালের দাম বাড়িয়ে দেন। প্রতিদিন ৫০০ টন চাল উৎপাদন হয় রশিদের মিলে। প্রতিকেজিতে ৫ টাকার ওপরে মুনাফা ধরলে প্রতিদিনই অতিরিক্ত লাভ হয় ২৫ লাখ টাকা। এক মাসেই আব্দুর রশিদ চাল বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা করছেন সাড়ে ৭ কোটি টাকারও বেসি। সিন্ডিকেটের এসব অর্থ তিনি বিভিন্ন দেশের জঙ্গিবাহিনীকে সহায়তা করে আসছেন।


আব্দুর রশিদের কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা, এ বিষয়ে খোঁজ নিলে কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন, আবদুর রশিদ এখন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের লোক। দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের হাত ধরে তিনি জামায়াত থেকে ও তার ভাই বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। এখন হানিফের পেছনে পেছনেই হাঁটছেন তিনি।


দলীয় কোনো পদে না থাকলেও আবদুর রশিদ এত দিন জামায়াতে ইসলামের সমর্থক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তার ভাই সিদ্দিকুর রহমান কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। এখন সদর উপজেলার আইলচারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আর সে কারণে চালের বাজারের অন্যতম এই নিয়ন্ত্রকের হঠাৎ আওয়ামী লীগে যোগ দেয়া নিয়ে কুষ্টিয়ার নেতাকর্মীদের মনে সন্দেহ। সেই সঙ্গে চালের দামের লাগাতার বৃদ্ধি সে সন্দেহকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।


কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিনিয়র এক নেতা জানান আবদুর রশিদ আগে জামায়াতে ইসলামের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও এখন সে আওয়ামী লীগ করছে। সময় হলে আবার জামায়াতে চলে আসবে। তাকে কেউ কিছু বলার বা করার সাহস রাখে না। কারণ সে অনেক বড় মাপের কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতার অর্থের যোগানদাতা বা ডোনার। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। রশিদ সেটাই করছে।



তবে জেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মেহেদি আহমেদ রুমি বলেন- আব্দুর রশিদ কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতে ইসলামের অন্যতম কর্মী ছিলেন। তার ভাই সিদ্দিকুর রহমান কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন, এখন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন।


অভিযোগের বিষয়ে আব্দুর রশিদের মুঠোফনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, অভিযোগের সব তথ্য সঠিক নয়। আপনাদেরকে আমার মিলে চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সাক্ষাতে কথা হবে।


বিবার্তা/শুভ/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com