শিরোনাম
সোনালি ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত জুমিয়ারা
প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:৩৪
সোনালি ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত জুমিয়ারা
লামা প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

জুমিয়াদের লাগানো ধান ও সাথী ফসলে ভরে উঠেছে বান্দরবানের সবুজ পাহাড়। রাতের হাওয়ায় পাকা ধানের শীষের সাথে আনন্দে দোলা দিচ্ছে জুমিয়াদের মন। জুমিয়া কৃষাণ কৃষাণীরা জুমে উৎপাদিত সোনালি ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।


প্রতিটি জুমের মাচাং ঘরে কিংবা পাড়ায় পাড়ায় চলছে ধান মাড়াই। সারা বছরের অন্নসংস্থানের আয়োজন হয় পাহাড়ের উৎপাদিত জুম ফসল থেকে।পাহাড়কে ঘিরে বেঁচে থাকার নিত্য দিনের সংগ্রাম জুমচাষীদের। ফসল ঘরে তোলার এই সময়টা জুমিয়ারা নবান্ন উৎসব হিসেবে পালন করেন। তারা রাতে নাচ, গান, সংস্কৃতির অংশ হিসেবে শূকর মেরে মদ্যপানসহ পালন করে নানা অনুষ্ঠান। মহানন্দে জুমিয়া পরিবারগুলো আগামী বছর আরও বেশি ফসল পাওয়ার আশায় দেবতাকে পূজা দেয়ার পর জুমের প্রথম ভাত মুখে তুলে নিচ্ছেন।


ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা জুমে ধানের পাশাপাশি ভূট্টা, মরিচ, যব, সরিষা, মিষ্টি ও চাল কুমড়া, চিনার, বেগুন, কাকন ধান, মারপা, তিল, পুই ও টকপাতাসহ হরেক রকমের শাক সবজি চাষ করেছেন। পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার জুমে রেকর্ড পরিমাণ জুম চাষ হয়েছে। ফলে জুমিয়া পরিবারগুলো খুশিতে আত্মহারা।


বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রমতে, এবারে বান্দরবানের ৭টি উপজেলায় ৯ হাজার ৮৮৮ হেক্টর পাহাড়ি জমিতে জুম চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ১২ হাজার মেট্রিক টন ধান। জেলার ১৫ হাজার ১৩৮ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার এ চাষের সাথে জড়িত। গতবারে এ চাষ হয়েছিল ৮ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে।



জানা যায়, জুম চাষ পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ঐতিহ্য। এখানে বসবাসরত ম্রো, মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চাঙ্গ্যাসহ ১০টি ভাষাভাষির ১১টি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই জুম চাষ করে থাকেন। লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাসহ জেলার ৭টি উপজেলার প্রায় প্রতিটি পাহাড়েই এবার রেকর্ড পরিমাণ জুম চাষ হয়েছে।


জেলা কিংবা উপজেলা সদরে বসবাসরত কিছু শিক্ষিত পরিবার ছাড়া পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি পরিবারগুলোর বেশির ভাগই জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। তবে এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র ম্রোরাই আদিকাল থেকে এখনো জুম চাষের মাধ্যমেই সারা বছরের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।


জুমিয়ারা জানান, একটি পাহাড়ে একাধিকবার জুম চাষ করা যায় না। এ কারণে প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন পাহাড়ে জুম চাষ করতে হয়। তারা বছরের মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের দিকে জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন দিয়ে পাহাড় গুলোকে চাষের উপযুক্ত করে তোলেন। মে জুন মাসের দিকে তারা আগুনে পোড়ানো পাহাড়ে ধানসহ সবজি বীজ রোপন শুরু করেন।


এরপর ৩-৪ মাস পরিচর্যা করে বছরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে জুমের ধান কাটা এবং অন্যান্য ফসল তোলা শুরু হয়। এখন জুমে উৎপাদিত ধান, মরিচ, মিষ্টি কুমড়া, মারপা, চিনার, টকপাতাসহ নানা ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জুমিয়ারা। জুমে উৎপাদিত সোনালি ধান ও ফসলের মৌ মৌ গন্ধ ছড়াচ্ছে এখানকার পাহাড়ি পল্লীগুলোতে।



স্থানীয়রা জানায়, পাহাড়ের জুমে উৎপাদিত সবজি ও ফসল খুবই সুস্বাদু। তাই এতাদাঞ্চলের হাট বাজারগুলোতে এ সকল ফসলের চাহিদা এবং দামও বেশি।


লামা উপজেলার রুপসীপাড়ার আলিয়াং বাবু পাড়া কারবারী নথিরাম জানায়, এবার তিনি ৪ একর পাহাড়ে জুম চাষ করেছেন। এতে সবমিলে তার খরচ হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। জুমে ইদুর কিংবা শুকরের আক্রমণ না হওয়ায় ৩০০ আড়ি ধান ঘরে তোলার পাশাপাশি প্রায় ২০-২৫ হাজার টাকার তিল, মরিচ, মিষ্টি কুমড়া ও বেগুন বিক্রি করেছেন। পার্শ্ববর্তী লামা ইউনিয়নের তাউপাড়ার মেনচং ম্রো ৫ একর পাহাড়ে জুম করে প্রায় ১ লাখ টাকা লাভ করেছেন।


একই কথা বললেন উপজেলার রাজা পাড়ার ক্যজ ত্রিপুরা, নাইক্ষ্যং মৌজা হেডম্যান চম্পুং ম্রো, লইক্ষ্যং মৌজার পারাও পাড়ার পারাও ম্রো, গজালিয়ার বড় ফারাং পাড়ার আকবি ত্রিপুরাসহ অনেকে।


আলীকদম উপজেলার দুর্গম চাইমপ্রা মৌজার গরামনি তঞ্চঙ্গ্যা জানায়, তিনি ১০ একর পাহাড়ে জুম চাষ করেছেন। গত শুক্রবার থেকে ধান কাটা শুরু করেছেন। এর আগে তিনি বেগুন, মারপা, চিনারসহ প্রায় ৪৫ হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেছেন। আরও প্রায় ১০ হাজার টাকার মত রয়ে গেছে।


আলীকদমের রোয়াম্বু এলাকার অনিল চাকমা ও ছিংথাই ম্রো জানিয়েছেন, প্রতিবছর জুমে ইদুরের আক্রমনে ব্যাপক ক্ষতি হলেও এবার ইদুরের আক্রমন দেখা যায়নি। কারণ হিসেবে পাহাড়ি বাঁশ বাগানে এবার ফুল ও ফল না আসাকে তারা উল্লেখ করেছেন। ফলে জুমে বাম্পার ফলন হয়েছে। তাদের জুমে বাম্পার ফলনে সারা বছরের খাদ্য নিশ্চয়তা লাভ করতে পারায় তারা এখন ভীষণ খুশি।


একইভাবে জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি, রুমা, থানছি ও রোয়াংছড়িসহ গোটা বান্দরবানের পাহাড়গুলোতে জুমের বিস্তৃতি ঘটেছে বলে জানা গেছে।


বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ সহকারী পরিচালক ভবতোষ চক্রবর্তী বলেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় গতবারের চেয়ে এবার বান্দরবানের সব কটি উপজেলার পাহাড় গুলোতে জুমের ফলন ভালো হয়েছে।


তিনি বলেন, জুম চাষ প্রকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় ক্ষতি করলেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি জনগোষ্টির কাছে এটি ঐতিহ্য। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করা গেলে পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হতো। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জুমিয়ারা লাভবান হবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।


বিবার্তা/আরমান/যুথি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com