শিরোনাম
চিকিৎসার নামে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের গলাকাটা বাণিজ্য
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৫:৪০
চিকিৎসার নামে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের গলাকাটা বাণিজ্য
তানভীর আঞ্জুম আরিফ, মৌলভীবাজার
প্রিন্ট অ-অ+

মৌলভীবাজার সহ জেলার প্রতি উপজেলা সদরের বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিগুলোতে চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়াসহ চলছে গলাকাটা বাণিজ্য। সরকারি স্বাস্থ্যনীতির তোয়াক্কা না করে এসব প্রতিষ্ঠান চিকিৎসার নামে রোগীদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। প্রায় প্রতিনিয়ত ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লিনিকগুলোতে অপচিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুসহ দুর্ঘটনার ঘটনা বেড়েই চলেছে।


সূত্র মতে, জেলা সিভিল সার্জন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মাঝে মধ্যে এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু করলেও মুহূর্তের মধ্যে নামসর্বস্ত্র অন্যসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে সংশ্লিষ্টরা আত্মগোপন করেন। ইতিমধ্যে দু-একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করে দেয়া হলেও কয়েকদিন পরে রহস্যজনকভাবে সিলগালা প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেহারায় ফিরে আসে। অভিযোগ রয়েছে, স্ব-স্ব এলাকার ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় প্রভাবশালী নেতার মালিকানায় এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানগুলো চিকিৎসার নামে বাণিজ্যিক কেন্দ্র খুলে বসেছেন।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে রোগীদের জন্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা কমিশন বাণিজ্যের নেশায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগকৃত দালালদের মাধ্যমে রোগীদের এসব অপচিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠাতে বাধ্য করছেন। ফলে প্রতিটি হাসপাতালের কমর্রত চিকিৎসকদের টেবিলের ওপর প্রকাশ্যেই ব্যাঙ্গের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নামসর্বস্ত্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অগনিত ভিজিডিং কার্ডের স্তূপ রয়েছে। এছাড়া ডাক্তারের কক্ষে রোগী প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ওইসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকৃত দালালরা বিভিন্ন টেস্ট যেন তাদের প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয় এজন্য ভিড় করছেন। দালালদের কারণে রোগী তার গোপন সমস্যার কথাও চিকিৎসকের কাছে বলতে পারছেন না। বর্তমানে প্রতিটি হাসপাতালে রোগীদের চেয়ে দালাল ও বিভিন্ন নামসর্বস্ত্র ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের উপস্থিতি বেশ লক্ষ্যণীয়।



সূত্র মতে, চিকিৎসকেরাও সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সেবা না দিয়ে দালালদের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিচ্ছেন নির্ধারিত বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিগুলোতে। চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে গোটা মৌলভীবাজার সাতটি উপজেলার গ্রাম অঞ্চলের নিভর্রতার বেশি। এ সুযোগে শহরের নামিদামি ডাক্তাররা কমিশন বাণিজ্যের নেশায় অসহায় রোগীদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন বিশাল খরচের খাতা। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন উন্নত চিকিৎসার আশায় শহরে আসা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের রোগীরা। অন্যদিকে এসব ডাক্তারদের সহায়তায় আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে উঠেছেন নামসর্বস্ত্র ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলোর মালিকেরা। চিকিৎসকেরাও ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও নামসর্বস্ত্র ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা গ্রহনের মাধ্যমে নিজেরাও গড়ে তুলেছেন অর্থ ও সম্পদের পাহাড়।


অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা না দিয়ে রোগীদের বিভিন্ন ক্লিনিকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর কাজে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে থাকেন হাসপাতালের কতিপয় অসাধু ডাক্তার, নার্স ও ওয়ার্ড বয়। রোগী পাঠিয়ে ওইসব নামসর্বস্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয় মোটা অঙ্কের কমিশন। এ নীতি এখন প্রতিটি হাসপাতালের ক্ষেত্রে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।


রোগীদের অভিযোগে জানা গেছে, জেলা শহর থেকে শুরু করে উপজেলার সদর হাসপাতালের সামনের বেসরকারি ক্লিনিকের মালিকরা নামিদামি এমবিবিএস ডাক্তারদের নামের তালিকা দিয়ে বিশাল সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রোগীদের প্রলুব্ধ করলেও মূলত এসব প্রতিষ্ঠান চলছে অদক্ষ হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে। ক্লিনিকগুলোতে এমবিবিএস ডাক্তার ও ডিপ্লোমাধারী প্রশিক্ষিত নার্স থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা নেই। দরিদ্র পরিবারের অল্পশিক্ষিত সুন্দরী মেয়েদের নার্সের পোশাক পরিয়ে চালানো হচ্ছে কার্যক্রম। এছাড়া রোগীদের চিকিৎসা করছেন অদক্ষ হাতুড়ে ডাক্তাররা। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের মিথ্যা প্রচার ও উন্নত চিকিৎসার প্রলোভনে পড়ে রোগীরা জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে উল্টো মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে।


ইতিমধ্যে জেনারেল প্রাইভেট হাসপাতাল সহ শহরের একাধিক বেসরকারি ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় অসংখ্য রোগীর মৃত্যু ও অপচিকিৎসায় দুরারোগ্যব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটে। অপরদিকে সুন্দরী নার্সদের সঙ্গে কথিত চিকিৎসক কিংবা ক্লিনিক মালিকদের প্রমোদ লীলার ও অভিযোগ রয়েছে।


শহরের শ্রীমঙ্গল রোডস্থ একাধিক চিকিৎসকদের চেম্বার ঘুরে দেখা গেছে, আক্ষরিক অর্থে চিকিৎসা ‘সেবা’ হিসেবে সর্বত্র পরিচিত হলেও এখন তা পরিণত হয়েছে সবচেয়ে দ্রুত অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে। হাসপাতাল থেকেই শুরু হয় রোগীদের নিয়ে ব্যবসার কাজ। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উন্নত চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা হাসপাতালে ভাল চিকিৎসা না পেয়ে ছুটছেন ডাক্তারের চেম্বারে। চেম্বারে এসেই প্রথমপর্যায়ে রোগীর সিরিয়াল নম্বর নিয়ে চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। দূরের রোগীদের এসে পড়তে হচ্ছে বিশাল সিরিয়ালের ফাঁদে। একটু নামি ডাক্তার হলেই তার সিরিয়াল চলে যায় ২শ’ এর উপরে। কেউ আবার ৩শ’ পর্যন্তও সিরিয়াল নেন।


বড়লেখা উপজেলা থেকে আসা ভুক্তভোগী রোগী মিতা বেগম বিবার্র্তাকে জানান, সামান্য পেটে ব্যথা নিয়ে ডাক্তার দেখাতে এসে সিরিয়াল পেয়েছেন ১৪২ নম্বরে। রাত ৯টায় সিরিয়াল চলছে মাত্র ৪৯। তিনি শুনেছেন ডাক্তার সাহেব রাত ৩টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। তাই ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন না বলে তিনি শহরের একটি আবাসিক হোটেলে সিট বুকিং করে রেখেছেন কেউবা যাবেন নিকটআত্মীয়ের বাসায়।
শহরের মধ্য ও নিম্নমানের প্রায় প্রতিটি আবাসিক হোটেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতিনিয়ত শহরে চিকিৎসা নিতে এসে সিরিয়ালের ফাঁদে পড়া অসংখ্য রোগীরা সিট বুকিং করে রাত্রীযাপনের পর সকালে গন্তব্যে চলে যাচ্ছেন। এত রাত পর্যন্ত রোগী দেখলে চিকিৎসা কতটা মানসম্মত হবে তা নিয়েও সচেতন নাগরিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন ।


সরজমিনে দেখা গেছে, সিরিয়ালের সমস্যা সমাধান হলেই ডাক্তার রোগীকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। বাইরে অতিরিক্ত রোগীর ভিড় তাই ৩-৪ মিনিট ও সময় দেয়া হয় না রোগীকে। হাতে টেস্টের বিশাল ফর্দ নিয়ে রোগী চলে যায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। কোনো কোনো ডাক্তার আবার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম উল্লেখ ও করে দেন টেস্টের জন্য। আবার কেউ কেউ সব লাভ নিজের পকেটে পুরতে চেম্বারের সঙ্গেই খুলে বসেছেন ছোটখাটো ডায়াগনস্টিক সেন্টার।


এ প্রসঙ্গে একাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মচারীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যেকোন ডাক্তার রোগী পাঠালেই তাকে টেস্টের ৪৫% কমিশন দেয়া হয়।


ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো কাগজপত্র জোগাড় করলেও অন্যক্ষেত্রে সব ফকফকা। ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনেরা অভিযোগ করেন, এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে পরীক্ষার রিপোর্ট কোনো অপারেশনের কাজে আসে না। এছাড়া ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অপারেশন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের পরীক্ষা নিরীক্ষাতে রিপোর্টের মানও ভাল নয়।


সূত্র আরও জানায়, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা হাসপাতালের ভেতরেই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালদের সহযোগিতায় রোগীদের কাছ থেকে ভিজিট নিয়ে থাকেন। যেসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে হাসপাতালের ডাক্তাররা প্রাইভেট চেম্বার করেন সেসব ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিকের দালালদের ডাক্তারাই নিজেদের স্বার্থে রুমে বসিয়ে রাখেন।


মৌলভীবাজার জেনালের হাসপাতালে বসে কথা হয় আছিয়া বেগম নামের এক রোগীর সঙ্গে। তিনি অভিযোগ বিবার্তাকে করে বলেন, ডাক্তারের কাছে গেলেই বাধ্যতামূলক রক্ত, প্রসাব, আলট্রাসনোগ্রাম, এক্সরে পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়া হয়। টাকা খরচ করে পরীক্ষা করে আনলেও সে রিপোর্ট কাজে আসে না। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলেন, আগের ওষুধই চলবে, আর কিছু লাগবে না। এ অভিযোগ শুধু আছিয়া বেগমের একারই নয় ; অন্যান্য রোগীরাও একই অভিযোগ করেন।


অন্যদিকে ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছে সব ডাক্তারাই জিম্মি রয়েছেন। প্রতি কোম্পানির কাছ থেকে মাসে মাসে মাসোহারা নিয়ে থাকেন এসব ডাক্তারা। পাশাপাশি ওষুধের স্যাম্পলতো রয়েছেই। এতে করে অখ্যাত ডাক্তাররাও মাসোহারা পাচ্ছেন লাখ টাকার ওপরে। আর নামী ডাক্তারদের মাসোহারার পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত।


এ প্রসঙ্গে নামকরা এক কোম্পানির প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবার্তাকে জানান, তিনি সর্বনিম্ন যে ডাক্তারকে প্রতিমাসে সম্মানি (মাসোহারা) দিয়ে থাকেন তার পরিমাণ ১০ হাজার টাকা। তার কোম্পানির সর্বোচ্চ ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত সম্মানির ব্যবস্থা রয়েছে। আর ডাক্তারের বাড়ির কোনো অনুষ্ঠান থাকলে চাহিদা মোতাবেক উপঢৌকন বা অনুষ্ঠান খরচ বহন করতে হয় ওষুধ কোম্পানিকেই। চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসাকারী এসব ক্লিনিক ও মালিকদের প্রতারণা বন্ধে এবং সরকারি হাসপাতালে অপারেশনসহ সব ধরনের ব্যবস্থা থাকার পরেও হাসপাতালের বাইরে থেকে টেস্টের নামে ডাক্তারদের কমিশন বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ভুক্তভোগী ও সচেতন মহল সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।


এ বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন সত্যকাম চক্রবর্তী বিবার্তাকে জানান, শুধু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের টেস্ট ফি কমালেই কতিপয় চিকিৎসকদের অভিনব ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব। কারণ সরকারি হাসপাতালে প্রতিটি পরীক্ষার ফি অপেক্ষা বাইরের পরীক্ষার ফি ১০ গুণ পর্যন্ত বাড়তি। বেসরকারি ক্লিনিক কিংবা ডায়গনস্টিক সেন্টারের ফ্রি যদি সরকার নির্ধারণ করে দেয় তবে সেন্টারগুলো অতিরিক্ত ফ্রি নিতে পারবে না। ফলে ডাক্তারদেরও ভাগ দিতে পারবে না। তাহলেই ডাক্তাররা রোগীদের ফ্রি ইচ্ছাকৃত প্রয়োজনীয় টেস্ট করাতে পাঠাবেন না।


তিনি আরও বলেন, যেসব ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে বৈধ কাগজপত্র নেই এবং স্বাস্থ্য নীতিমালা মানা হচ্ছে না সেসব প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যেকোন সময় ঝটিকা অভিযান চালানো হবে।


বিবার্তা/আরিফ/প্লাবন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com