দেশের বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে প্রতিনিয়ত টোকেনের মাধ্যমে প্রভাবশালীমহল মৎস্য ব্যবসায়ীদেরকে দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন রমরমা বাণিজ্য। সম্প্রতি এই বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন প্রভাবশালী একটি চক্র। আর এই অবৈধ কাজে যুক্ত রয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ও প্রশাসনের বড় কর্তারা। ফলে হাকালুকির বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে মাছের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিদিন চলছে মাছ আহরণের অবৈধ টোকেন খেলা।
সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোর বাসিন্দারা প্রশাসনের সহায়তা পেয়ে বাণিজ্যের এ সিন্ডিকেট তৈরি করে নির্বিঘ্নে মাছ আহরণ চলছে। আর এই অবৈধ বাণিজ্যের ভাগ ভাটোয়ারা প্রশাসনের বড় কর্তারাও নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব অবৈধ জালের মালিকরা এতই বিত্তবান যে বিলগুলো ইজারা নেয়ার সময় তারাই নেন। জালের মালিকরাই মূলত সৃষ্টি করেছে টোকেন সিস্টেম। টোকেন ছাড়া জাল দিয়ে মাছ ধরে ডাঙ্গায় উঠলেই মাছসহ ধরা পড়ে যেতে হয় উপজেলা মৎস্য অফিসে। সেখানে গিয়ে আর মাছ ধরবে না হাওরে এমন শর্তে মুচলেকা দিয়ে টোকেন নিয়ে পুনরায় শিকারে বেরিয়ে পড়ে। চলতি বছর ১৭ জুন এমন দুজন শিকারি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জুড়ী উপজেলা মৎস্য অফিসে গিয়ে মুচলেকায় ছাড়া পেয়ে যান।
শিকারিরা জানান, প্রতিটি জালের সঙ্গে ২০-৩০ জন করে শিকারি থাকে। ২০০০ হাত জালে থাকে ৫০ থেকে ৬০ জন। শিকারিদের এসব জাল চারশ’ পাঁচশ’, বারশ’ ও দুই হাজার হাত লম্বা হয়ে থাকে। শিকারিদের সবচেয়ে ক্ষতিকারক জাল হচ্ছে তিতপুটি মারার কৌশলি জাল। একে বিষ জালও বলা হয়। এই জাল দিয়ে শিকারিরা ছোট ছোট মাছের পোনা ধরে, গলফা জাল দিয়ে শিকার করা হয় বড় বড় মাছ।
জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া-জুড়ী-বড়লেখা ও সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ এই ৬টি উপজেলায় সম্পৃক্ত মিঠাপানির বৃহত্তম হাকালুকির ২৩৮টি বিলে।
এলাকাবাসী জানান, হাকালুকি হাওর এলাকায় অবস্থিত জুড়ী উপজেলার শাহাপুর, জাঙ্গিরাই, নয়াগ্রাম ও খাগটেখা মৌজার কয়েকশ মানুষ হাওরে মাছ শিকারে নিয়োজিত রয়েছে। অনুরূপভাবে অন্য পাঁচটি উপজেলার শিকারি রয়েছে হাকালুকিতে। এসব শিকারিরা তাণ্ডব চালাচ্ছে ২৪ ঘণ্টাই। ফলে শুধু মাছই নির্বংশ হচ্ছে না, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে হাকালুকির জলজ উদ্ভিদের অস্তিত্ব। হোগা (চাপিলা), ইছা, কাচকি ও তিতপুঁটি শিকারের নামে এসব মৎস্য শিকারি ও সিন্ডিকেট সদস্যরা শিকার করে নিচ্ছে সব ধরনের মাছ। তিন শতাধিক বেড় জাল নিয়ে এসব শিকারি হাকালুকিতে মাছ শিকার করছে। শিকারিরা বিত্তবান শ্রেণির না হলেও জালের মালিকরা সবাই বিত্তবান।
শিকারিদের সঙ্গে জালের মালিকদের চুক্তি হলো সব খরচ বাদে জালের ১ ভাগ, শিকারিদের ২ ভাগ। তাতে করেই শিকারিদের জন প্রতি আটশ’ থেকে এক হাজার টাকা দৈনিক আয় হয়।
শিকারিদের কাছ থেকে সামছুল হক নামের এক ব্যক্তি হাওর রক্ষা কমিটির নামে চাঁদা নেয়। হাওরের মধ্যে কত টাকার মাছ শিকার হলো তার হিসাব রাখা হচ্ছে প্রতি মুহূর্তের কাজ। তবে বাসিন্দাদের ভাগ্যে এসব মাছ খুব কম জুটে। সব মাছ রাজধানীতে চলে যায়। প্রকাশ্য ব্যবসা হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তাতে নজর দেয় না। প্রশাসনের নির্লিপ্ততার কারণ জানা আছে স্থানীয় জনসাধারণের। হাকালুকিতে মাছ না ধরলে সরকারিভাবে প্রতি মাসে ভাতা দেয়া হবে- এমন কথা বলে শিকারিদের আইডি কার্ড জমা নেয়া হয়।
শিকারি আলমগীর (৪৭ ) ও তাহের আলীকে (৫৩) বেআইনি মাছ শিকার সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানান, বেআইনি জেনেও শিকার করতে হচ্ছে। এছাড়া জীবিকা নির্বাহের কোনো পথ নেই। তাহের আলী আরও জানান, আটজন সদস্যের পরিবারে তিনিই একমাত্র রোজগারি। তিনি একটি মামলায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তিন মাস জেল খেটেছেন। সেই মামলায় প্রায় লাখ খানেক টাকা এ পর্যন্ত খরচ করেছেন। মামলাটি এখনও শেষ হয়নি বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য অফিসার মো. সুলতান মাহমুদ বিবার্তাকে জানান, ১৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিপুল সংখ্যক অবৈধ কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি হাওর রক্ষার স্বার্থে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে শিকারিদের প্রতিরোধের চেষ্টা চলছে।
বিবার্তা/আরিফ/প্লাবন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]