চলছে বর্ষা মৌসুম, তাই কর্মব্যস্ত নড়াইলের ডুঙ্গার কারিগররা। কেউ তালগাছ কিনতে ব্যস্ত, কেউ গাছ কাটতে, কেউ ব্যস্ত সেই গাছ দিয়ে ডুঙ্গা তৈরিতে, কেউবা আবার ব্যস্ত সেই ডুঙ্গা বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে। এই দৃশ্য দেখা যায় নড়াইলের ডুঙ্গা কারিগর ও শ্রমিকদের মধ্যে।
চলতি বছর বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই বৃষ্টি বেশি হওয়ায় বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গেছে, তাই তালগাছ দিয়ে তৈরি ডুঙ্গার চাহিদাও বেড়েছে। জমে উঠেছে জেলার চাচুড়ী, তুলারামপুর, দিঘলিয়াসহ নড়াইলের কয়েকটি ডুঙ্গার হাট। নড়াইলের ডুঙ্গা যাচ্ছে বিভিন্ন জেলায়। এবার ডুঙ্গার চাহিদা বেশি থাকায় দামও গতবারের চেয়ে বেশি। এতে ডুঙ্গার কারিগর ও ব্যবসায়ীরা বেশ খুশি।
সবচেয়ে বড় ডুঙ্গার হাট নড়াইল সদরের তুলারামপুর হাট। এখানে ডুঙ্গা কেনাবেচা করতে আসে বিভিন্ন জেলার মানুষ। সপ্তাহে শুক্র আর সোমবার হাট বসে এই হাটে। বর্ষার শুরু থেকে অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার মাস এই হাটে চলে ডুঙ্গা কেনা-বেচা।
জেলার প্রতিটি হাটে কয়েকশ’ ডুঙ্গা বেচাকেনা হয় । আর এই ডুঙ্গার সুনামও রয়েছে বেশ। তাই এখানে ডুঙ্গা কিনতে আসেন নড়াইলের বিভিন্ন উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী মাগুরা, ফরিদপুর, যশোর, গোপালগঞ্জ, সাতক্ষিরা, বাগেরহাট, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলার ব্যাবসায়ীরা।
কারিগররা জানান, বছরে তাদের চার থেকে পাঁচ মাস এই কাজ করতে হয়। বাকি সময় অন্য কাজ করেন তারা। যে যতবেশি কাজ করে, তার ততবেশি আয় হয়। প্রতিদিন একজন কারিগর ৭০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। আর একজন শ্রমিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করতে পারে।
আকারভেদে একটি তাল গাছ তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সাধারণত একটি তালগাছ থেকে দুটি ডুঙ্গা তৈরি হয়। ক্রেতার চাহিদা আর পরিমাপ বুঝে একেকটি ডুঙ্গা দুই হাজার থেকে ৫৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। বর্ষার কারণে বিলে পানি বাড়লে ডুঙ্গার চাহিদাও বাড়ে।
বিভিন্ন জেলা থেকে তুলারামপুর হাটে আসা ডুঙ্গার ক্রেতা রফিকুল ইসলাম, মলয় দাস, অঞ্জন দাসা, বিজয় ঘোষ জানান, নড়াইলে কারিগরদের তৈরি ডুঙ্গার মান ভালো। এই ডুঙ্গা অনেক দিন ব্যাবহার করা যায়। এখান থেকে ডুঙ্গা কিনে তারা বিভিন্ন জেলায় বেচেন। তাদের লাভও ভালো হয়। হাটের পরিবেশ ভালো। রাস্তার পাশে হাট তাই এখান থেকে ডুঙ্গা কিনে সহজে ভ্যান, নসিমন, করিমন, মিনি ট্রাক, ট্রাকে করে নেয়া যায়।
কারিগররা জানান, একটি ভালো তালগাছ মাটির ভেতর থেকে বের করে শিকড়সহ কাটা হয়। এরপর গোড়ার অংশটি সুচালো করে ৯ হাত রেখে আলাদা করা হয়। গাছটির মাঝামাঝি অংশ দাগ দিয়ে হাত করাত দিয়ে ধীরে ধীরে এপাশ ওপাশ কেটে দুভাগ করা হয়। ভেতরের নরম অংশ শাঁস পরিষ্কার করে তৈরি হয় ডুঙ্গা। এরপর হাত বাশলে দিয়ে ধীরে ধীরে মসৃণ করার পর ডুঙ্গা বিক্রি করা হয়।
ডুঙ্গা ব্যবসার সাথে জড়িত সদরের চর শালিখা গ্রামের সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আমি নিজে ডুঙ্গা তৈরি করি। তিনি জানান, তিনজন শ্রমিক একদিন কাজ করলে দুটি ডুঙ্গা তৈরি করতে পারে এবং বাজারে নেয়া খরচসহ বিক্রি বাবদ অন্তত তিন হাজার টাকা লাভ করা যায়।
সদরের ভবানীপুর গ্রামের ডুঙ্গা ক্রেতা আব্দুর রশিদ শেখ বলেন, চলতি বছর বৃষ্টি বেশি হওয়ায় তার বাড়ির চারিপাশে পানিতে তলিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে বের হওয়া যায় না পানির জন্য। তাই তিনি ডুঙ্গা কিনতে এসেছেন। তার অভিযোগ, গত বছরের চেয়ে এ বছর প্রতিটি ডুঙ্গার দাম ৫০০ থেকে ১৫শ’ টাকা পর্যন্ত বেশি।
সাতক্ষীরা থেকে ডুঙ্গা কিনতে আসা ব্যবসায়ী বাসার বেগ জানান, তিনি প্রতি বছর নড়াইলে ডুঙ্গা কেনেন। তিনি এখান থেকে ডুঙ্গা কিনে বিভিন্ন জায়গায় বেচেন। এতে তার লাভও ভাল হয়। গত বছরের থেকে এ বছর ডুঙ্গার দাম বেশি বলেও তিনি জানান।
বিল আর খালে পরিপূর্ণ নড়াইলের বিভিন্ন এলাকায় তাল গাছের তৈরি ডুঙ্গার (যাকে কোষা নৌকা বলে) ব্যবহার বেড়েছে। খাল আর বিল পাড়ের হাজারো মানুষের একমাত্র বাহন এই ডুঙ্গা। নদী থেকে খালে প্রবেশ করতে, খাল পাড়ি দিয়ে বাজার বা বিভিন্ন কাজ করা, বিল থেকে মাছ ধরা-শাপলা তোলা থেকে গ্রামীণ জনপদের অতি প্রয়োজনীয় এই বাহন। নৌকা চালনায় বেশি পানি লাগলেও কম পানিতেই চলে ডুঙ্গা। আকারে ছোট আর চালনায় সহজ বলে পাঁচ বছরের শিশু থেকে নারীরা পর্যন্ত এই বাহন ব্যবহার করে।
বিশিষ্ট শিক্ষনুরাগী নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক শিক্ষক প্রদ্যুৎ ভট্টাচার্য্য বলেন, তালগাছ দিয়ে তৈরি ডুঙ্গা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। দিন দিন তালগাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় কমছে ডুঙ্গার ব্যবহার। নড়াইলের এ বাহনটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে বেশি বেশি তালগাছ লাগানো প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন এই প্রবীণ শিক্ষক।
বিবার্তা/শরীফুল/নিশি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]