শিরোনাম
অনাহারে হাওরাঞ্চলের মৎস্যজীবীরা
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০১৭, ১১:১৭
অনাহারে হাওরাঞ্চলের মৎস্যজীবীরা
তানভীন আঞ্জুম আরিফ, মৌলভীবাজার
প্রিন্ট অ-অ+

মৌলভীবাজারের হাইল হাওরের সাধারণ মানুষ ও এলাকার মৎস্যজীবী সম্প্রদায় মানবেতর জীবন-যাপন করেছেন। বর্ষ মৌসুমে তাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন মাছ ধারা। কিন্তু এখন মাছ খুব একটা মিলছে না। অনেকেই আবার খালি হাতেই ঘরে ফিরছেন। অন্যরা যা পান, তা দিয়েও সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। কেউ কেউ মাঝে-মধ্যে ত্রাণও পেয়ে থাকেন, অনেকেই আবার ত্রাণ থেকেও বঞ্চিত। আর তা দিয়েই দু-একদিন চললেও বাকি দিনগুলো কাটছে অনাহারে।


সরেজমিনে দেখা গেছে, সদর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাইল হাওরের কালাইপুরা গ্রামের অনেক বাড়ির চারদিকে পানি ঢেউ খেলছে। কারও আবার উঠানে পানি, কারও উঠানে কাদা। কারও ঘর থেকে পা ফেললেই পানি। নৌকা ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। হাওরে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি বাড়ি থেকে নৌকা নিয়ে বের হয়েছেন জেলেরা। সঙ্গে নৌকাবোঝাই জাল।


কালাইপুরা গ্রামটি পড়েছে সদর উপজেলার একাটুনা ও আখাইলকুরা ইউনিয়নের মধ্যে। আর কাউয়াদীঘি হাওর পড়েছে সদর ও রাজনগর উপজেলায়। একাটুনা ইউপির কালাইপুরা গ্রামের রেনু মিয়া জানান, হকলতা যারগি পানির মোরে (সবকিছু পানির নিচে চলে যাচ্ছে)। গরিব মানুষ। বছর বছর বাঁশ-বেড়া দিয়া ঘর বানাই। ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ অয়। এমনিতেই এবার পানিয়ে খেত (বোরো ধান) খাইলিছে। হক্কল মরাত (সবাই ক্ষতিগ্রস্ত)। এখন চারদিকে পানি। কিন্তু মাছ মিলে না। সারা দিনে দুই-আড়াইশ টাকার মাছ পাই। কোনো দিন খালি খাওয়ার মাছ মিলে। আফাল (ঢেউ) থাকলে কিছুই মিলে না। এখন এক কেজি চাউলর দাম ৫০ টাকা। আটজনের পরিবার। উফাস-কাফাস করি চলি। মাঝে-মধ্যে ঋণ করি।


তিনি আরও জানান, রেনু মিয়া নিবন্ধিত মৎস্যজীবি। এ পর্যন্ত মাত্র একবার ৬ কেজি চাল সাহায্য পেয়েছেন।


নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে হাওরে যাচ্ছিলেন আখাইলকুরা ইউপির খইসাউড়া গ্রামের সাজ্জাদ আলী। তিনি বলেন, মাছ ধরতে যাইরাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ ধরমু। বন্যার কারণে দিনে একশ-দেড়শ’ টাকার মাছ মিলে। আমার কার্ড (নিবন্ধনপত্র) নাই দেইখা কোনো সাহায্যও পাইছি না।


সদর উপজেলার একাটুনা ও আখাইলকুরা এবং রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউপির কালাইপুরা, খইসাউড়া, খোঁজারগাঁও, কানিয়া, নারাইণপুর, বড়বাড়ি, চঙবাড়ি, অন্তেহরি, কাদিপুর, জুমাপুরসহ পাশাপাশি গ্রামগুলোতে বাসবাস কয়েক হাজার মৎস্যজীবী পরিবারের। এসব গ্রামের মৎস্যজীবী পরিবারের সদস্যরা কাউয়াদীঘি হাওর থেকে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা জানান, অন্য বছর বর্ষার এই সময়টিতে হাওরে পানি অনেক কম থাকতো। একজন মৎস্যজীবী দিনে ৪০০-৫০০ টাকার মাছ ধরতে পারতেন। কিন্তু এখন...?


কালাইপুর গ্রামের টুনু মিয়ার বাড়ির উঠানে পানি। বারান্দায় বসে দু’জন নারী জাল বুনছেন। কেউ তরকারি কাটছেন। টুনু মিয়া জানান, ১০ কিয়ার (বিঘা) খেত করেছিলাম। সব পানিয়ে ভাসাই নিছে। খেত করি ১৭ হাজার টাকা দেনা অইছে। কিলা (কিভাবে) শোধ করতাম? পানি কমলে না রুজি করতাম। দিনে দুই-আড়াইশ’ টাকার মাছ পাই। এই টাকায় খালি চাউল কিনলেই চলেনি। অন্য খরচও তো আছে। ওষুধও লাগে। টানাটানি করি কোনো রকম চলরাম। কোনো কিচ্ছু এখন পর্যন্ত পাইছি না।


একই বাড়ির রাবেয়া বেগম, হোসনা বেগম জানালেন, একই কথা তারা এখন পর্যন্ত কোনো সাহায্য পাননি। তবে রুজিনা বেগম বলেন, তিনি ৮ কেজি চাল পেয়েছেন।


খইসাউড়া গ্রামের ইলাল মিয়া জানান, তারা ১৩ জন প্রত্যেক দিন দু’টি নৌকা নিয়ে কাউয়াদীঘি হাওরে মাছ ধরতে যান। সবাই মিলে দুই-আড়াই হাজার টাকার মাছ পান। এতে জনপ্রতি ১০০-১৫০ টাকা ভাগে পড়ে। কোনো দিন আবার খালি হাতেও ফিরতে হয়। তিনি এবার ১০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছিলেন। কিন্তু বন্যার কারণে ঘরে তুলতে পারেননি একমুঠো ধানও


অপরদিকে জেলার হাওরতীরবর্তী তিন উপজেলা তথা বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলার মৎস্যজীবী পরিবারে চরম দুর্দিন চলছে। বড়লেখার হাল্লা, খুটাউরা, আহমদপুর, মুর্শিবাদকুরা, মুন্সিনগর, নোয়াগাঁও, কাজিরবন্দ; জুড়ীর বেলাগাঁও, শাহাপুর এবং কুলাউড়ার সাদীপুর গ্রামে বেশিরভাগ মৎস্যজীবী পরিবারের বাস। এসব এলাকায় বন্যার পানি কমলেও দুর্ভোগ তাদের কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। হাওরে জাল নিয়ে গিয়েও মাছ ধরা পড়ছে খুবই কম।


জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানা যায়, জেলায় ১৩ হাজার ৪০০ নিবন্ধিত মৎস্যজীবী আছে। তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিবন্ধনের বাইরেও অনেক মৎস্যজীবী রয়েছেন।


জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুছ আকন্দ জানান, এবার আগাম বন্যা হওয়ায় মাছের উৎপাদন কিছুটা ভালো হয়েছিল। এই অসময়ে মাছ কিছুটা কম ধরা পড়ে বলেও জানান তিনি।


একাটুনা ইউপি চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ান জানান, এই ইউনিয়নে দুই থেকে আড়াই হাজার মৎস্যজীবী আছে। এদের দুই-চারজন বাদে সবাই অভাবে। তবে আমার ইউনিয়নে এমন কেউ নাই, যে ত্রাণ পায়নি। ইতিমধ্যে ১৪ টন চাল ও ৫ টন গম বিতরণ করা হয়েছে। আগামীতে আরো করব।


সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইকবাল হোসেন জানান, মৎস্যজীবীদের জন্য আমাদের এখানে আলাদা কোনো কর্মসূচি নেই। তবে সাধারণ বরাদ্দের আওতায় তারা ত্রাণ পাচ্ছেন।


বিবার্তা/আরিফ/প্লাবন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com