শিরোনাম
ভণ্ড হাবিবের প্রতারণায় নিঃস্ব তাসলিমা
প্রকাশ : ২৩ মে ২০১৭, ১৬:৪৫
ভণ্ড হাবিবের প্রতারণায় নিঃস্ব তাসলিমা
যশোর প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

গত এক বছরে মেয়ের অসুস্থতার দুর্বলতাকে পুঁজি করে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে এক নারীকে নিঃস্ব করেছে কবিরাজ নামধারী প্রতারক হাবিবুর রহমান। ভণ্ড কবিরাজ হাবিবের খপ্পরে পড়ে পথে বসেছেন তিনি।


ওই কবিরাজের টাকার চাহিদা মেটাতে গিয়ে তিনি প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনসহ এনজিও-সমিতির কাছে ধার দেনায় জর্জরিত। কখনো মৃত্যুর ভয়, সম্পদের লোভ দেখিয়ে এই অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে ওই কবিরাজ। কবিরাজ হাবিবুর রহমান (৩২) মণিরামপুর উপজেলার ধলিগাতী গ্রামের কটাই মোড়লের ছেলে। এই কবিরাজ কখনো নাগরাজ, কখনো জ্বিন বলে নিজেকে জাহির করে এলাকায়।


প্রতারণার শিকার যশোরের মণিরামপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের গৃহবধূ তাসলিমা খাতুন। তিনি যখন এসব তথ্য দিচ্ছিলেন তখন তার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছছিলেন। সরেজমিনে ওই ভুক্তভোগী পরিবারের বাড়িতে গেলে মুহূর্তেই বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ হাজির হন সেখানে।


তাসলিমা বলেন, গত রমজান মাসের কয়েকদিন পর মেয়েকে নিয়ে তিনি ও তার স্বামী ওই কবিরাজের বাড়িতে গেলে প্রথম দিনই কবিরাজ ৬ হাজার ১২১ টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রথম দিন তার স্বামীকে পান খেতে দিয়ে কবিরাজ বলেন, বাড়ি যেতে যেতে তার স্বামীর পাতলা পায়খানা হলে তাতে তারা যেন চিন্তিত না হয়। আর এ রকম হলে বুঝতে হবে মেয়েটি ভালো হয়ে যাবে। এরপর বাড়ি আসার পর স্বামীর ওই উপস্বর্গ দেখা দিলে কবিরাজের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস জন্ম নেয়। এভাবেই শুরু। এরপর হঠাৎ একদিন মেয়ে অসুস্থ হলে কবিরাজকে খবর দেয়া হলে তিনি বাড়িতে এসে বোঝান তার মেয়ে মানুষের সন্তান নয়। সে নাগরানী। তাকে দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে হবে। এজন্য এখনি ১৩ হাজার ২১ টাকা দিতে হবে। সাথে সাথেই তারা সরল বিশ্বাসে টাকা দেন কবিরাজ হাবিবুরকে।


এসময় কবিরাজ তাদেরকে বলেন, মেয়ে নাগরানী হওয়ায় তোমাদের জন্য সে প্রচুর ধন সম্পদ এনে দেবে। আর এসব কথা অন্য কাউকে বলতেও নিষেধ করে কবিরাজ হাবিবুর। বললে তার মেয়ে আর বাঁচবে না বলেও তাদের ভয় দেখায়। শুধু তাই নয়, সাপ ও জ্বিনকে সন্তুষ্ট রাখতে বাড়ির সামনে থাকা জাম গাছের নিচে প্রতিদিন দুধ কলা ও বসত ঘরের প্রবেশ দ্বারের দু’ধারে দুটি নীলকণ্ঠ ও হাসনা হেনা ফুল গাছ রোপনের কথা বলেন কবিরাজ। সাথে সাথে সাবধান করে দেন-খবরদার কোনো পশুপাখি কিংবা কোনো মানুষ যেন গাছের পাতা, ফুল, ডাল না ছেড়ে। ছিড়লে তার মেয়ের চরম ক্ষতি হবে। এমনকি মারাও যেতে পারে। জাম ও ফুল গাছ বেড়া দিয়ে ঘিরতেও নিষেধ করে কবিরাজ। হঠাৎ একদিন ৫ বছরের ইমন নামে তার এক আত্মীয়ের ছেলে জাম গাছের পাতা ছেড়ায় ফোনে কবিরাজকে জানালে তিনি বলেন, জ্বিনেরা ক্ষেপে গেছে। তাদের ঠাণ্ডা করতে এখনি ২১ হাজার ১২১ টাকা লাগবে। মেয়ের কথা চিন্তা করে কবিরাজের বিকাশ নম্বরে টাকা দেয়া হয়। এরপর ছাগলে পাতা খেলে, দেবরের ছেলে নাহিদ ফুল ছিড়লে কবিরাজকে জানালে বিকাশ নম্বরে টাকা দিতে হয়। এসব কবিরাজকে জানানোর কারণ মেয়েটি প্রায়ই অস্বাভাবিক আচরণ করতো।


তসলিমা জানান, এভাবে গত এক বছরে তাদের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ হাতিয়ে নিয়েছে কবিরাজ হাবিব। মেয়ের অসুস্থতাকে পুঁজি করে শুধু স্বামী আবু বক্করের কাছ থেকে নয়, তিনি নিজেও গয়না বন্ধক রেখে, কখনো ধার দেনা করে স্বামীর অগোচরে প্রায় ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এভাবে প্রায় এক বছর প্রতারিত করে আসছিল কবিরাজ হাবিব।


এসময় সেখানে উপস্থিত সোহরাবের স্ত্রী আমেনাকেও জ্বিনের কথা বলে ৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় বলে জানান। বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে আবু বক্কর তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বিষয়টি স্থানীয় আইন সহায়তা কেন্দ্র নামে এক বেসরকারি সংস্থাকে জানায়।


সংস্থার সভাপতি আজিজুর রহমান জানান, গত ৭ মে সোমবার সকালে অভিযোগ পেয়ে ওই দিন বিকেলে সংস্থার ১৮ জন সদস্য তিন ভাগে ভাগ হয়ে রোগী সেজে ওই কবিরাজের বাড়িতে যান। তাদের এক নারী সদস্য যার স্বামী-সন্তান নেই। এ সময় তার মেয়ে অসুস্থ জানিয়ে কবিরাজের সাহায্য চান। কবিরাজ তাকে জানায়, তার মেয়ে জ্বিন ও মানুষ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কথা বলার পর কবিরাজকে ধরে এনে সন্ধ্যায় থানায় সোপর্দ করা হয়। এরপর আবু বক্কর বাদী হয়ে প্রতারণার অভিযোগে হাবিবুর রহামনে বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন। সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়ে হাবিব কবিরাজ আবারো লোক ঠকাতে নেমে পড়েছে।


এসব অভিযোগ নিয়ে হাবিবুরের সাথে কথা হলে তিনি প্রতারণার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, তার কাছে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের কবিরাজি লাইসেন্স রয়েছে। এসময় বিকাশে ৩৬ হাজার টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেন কবিরাজ। জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান বলেন, প্রায় বছর দু’য়েক আগে হাবিব ব্যবসার কথা বলে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছিল। যা পরে আর নবায়ন করেনি।


এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাবিবের প্রতিবেশীরা জানায়, কয়েক বছর আগেও হাবিব পরের জমিতে কামলা দিত। অথচ এখন যেন সে আলাউদ্দীনের চেরাগ পেয়েছে। এখন তার ফ্লাট বাড়ি, পাকা রান্না ঘর, গোয়াল ঘর-সব খানেই আধুনিকতার ছোঁয়া।


মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই জহির রায়হান জানান, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, গত এক এক বছরে ভুক্তভোগী আবু বক্করের দেয়া বিকাশ নম্বর থেকে বিভিন্ন সময় কবিরাজের বিকাশ নম্বরে ৩৮ বারে প্রায় দুই লাখ টাকা দেয়া হয়েছে।


বিবার্তা/তুহিন/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com