
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে আবারও বন্য হাতির আক্রমণে প্রাণ গেল মাত্র দুই মাসের শিশু আয়মান জাওয়াদের। ভয়াবহ এ ঘটনায় শিশুটির মা খতিজা বেগম (৩৫) গুরুতর আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
শুক্রবার (২১ মার্চ) গভীর রাত ২টার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। হাতির তাণ্ডবে অন্তত ১০টি বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৫-৬ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
নিহত শিশু আয়মান কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের শাহমীরপুর (৫ নম্বর ওয়ার্ড) জমাদার পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ছেলে।
আয়মানের বাবা মোহাম্মদ ইব্রাহিম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, 'আমাদের কিছুই রইল না, ঘর ভেঙে দিল, ছেলেটাকেও নিয়ে গেল…'।
প্রত্যক্ষদর্শী সেলিম জানান, প্রতিদিনের মতো গ্রামবাসী গভীর রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ কেইপিজেড (কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন) সংলগ্ন পাহাড় থেকে একটি বড় হাতি নেমে আসে লোকালয়ে। মুহূর্তের মধ্যে তাণ্ডব শুরু করে।
হাতিটি প্রথমে জমাদার পাড়ার মতিউর রহমান ট্যান্টলের বাড়িসহ আশপাশের অন্তত ১০টি বাড়িতে হামলা চালায়। দরজা-জানালা ভেঙে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বিভিন্ন আসবাব গুড়িয়ে দেয়। আতঙ্কে গ্রামবাসী দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন।
মোহাম্মদ ইব্রাহিম কোনো রকমে পালিয়ে যেতে পারলেও তাঁর স্ত্রী খতিজা বেগম সন্তান নিয়ে বের হতে গিয়ে হাতির সামনে পড়ে যান। তাড়াহুড়োতে মাটিতে পড়ে গিয়ে আয়মানের মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। আহত খতিজাসহ শিশুকে লোকজন উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে খতিজা বেগম কে ভর্তি করে শিশু আয়মান কে মৃত ঘোষণা করে কর্তব্যরত চিকিৎসক।
জানা গেছে, হাতির আক্রমণ নতুন কোনো ঘটনা নয়। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলায় গত ১২ বছরে বন্য হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ জনেরও বেশি মানুষ। অসংখ্য বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে হাতির দল। কিন্তু বন বিভাগ, কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। ফলে বনের হাতি এখন বনে নেই, বরং লোকালয়ে নেমে এসেছে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে।
বিগত বছরগুলোতে বড়উঠানের দৌলতপুর, দক্ষিণ শাহমীরপুর এবং আনোয়ারার গুয়াপঞ্চক, বৈরাগ, মোহাম্মদপুর, ফকিরখিল, বটতলী, হাজিগাঁও, গুচ্ছগ্রামসহ বহু এলাকায় তিন শতাধিক বাড়িঘর হাতির হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছে। বারবার প্রাণহানি ঘটলেও আজ পর্যন্ত টেকসই কোনো সমাধান আসেনি।
স্থানীয় সমাজসেবক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, 'কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, জেলা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন কমিটির মাধ্যমে হাতিগুলোকে পুনর্বাসন (রিলোকেট) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হবে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ আর দেখা গেল না। এরই মধ্যে আমরা বারবার মানুষ মরতে দেখছি।'
মানুষ বন দখল করেছে, হাতি মানুষকে হত্যা করছে—সমাধান কোথায়?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বন উজাড় করে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল দখল করে নেওয়ার ফলেই হাতির আক্রমণ বাড়ছে। কর্ণফুলী ইপিজেডসহ আশপাশের এলাকায় বন ধ্বংস করে স্থাপনা গড়ে তোলায় হাতির চিরচেনা পথ বন্ধ হয়ে গেছে। খাবারের অভাবে তারা লোকালয়ে নেমে আসছে। অথচ টেকসই সমাধানের বদলে দায়সারা উদ্যোগেই সীমাবদ্ধ প্রশাসন।
এদিকে হাতির আক্রমণের আতঙ্কে পাহাড়পাদদেশে বসবাসকারী হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন। যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। হাতি আর মানুষের দ্বন্দ্বে একদিকে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণ, অন্যদিকে বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষার নামে নেওয়া কাগজে-কলমের পরিকল্পনাগুলো কার্যকর না হওয়ায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
প্রশ্ন থেকে যায়—মানুষ আর কত প্রাণ হারালে প্রশাসনের টনক নড়বে?
বিবার্তা/জাহেদ/এমবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]