কালের বিবর্তনে হারাচ্ছে ভোলাহাটের শিব মন্দির
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:১০
কালের বিবর্তনে হারাচ্ছে ভোলাহাটের শিব মন্দির
চাঁপাই নবাবগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে সদর ইউনিয়নের পশ্চিমে থানার আশেপাশে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাজার বছরের পুরানা ঐতিহ্য বহনকারী হিন্দু ধর্মালম্বীদের শিবমন্দির। এ যেন নিপুণ হাতের কারুকার্য খচিত নকশার বহিঃপ্রকাশ। তবে মন্দিরগুলো মনোমুগ্ধকর পরিবেশের মধ্যে না থাকায়, কারোরই বিশেষ করে সরকার সু-দৃষ্টি না দেয়ায় যেন জরাজীর্ণ, জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে কালের বিবর্তনে এগুলি ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। জরুরি ভিত্তিতে এগুলির সংস্কার প্রয়োজন। তানা হলে যেকোনো সময় মারাত্মক ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হবে মন্দির ঘেঁষা বসবাসরত জনসাধারণ।


এই ভোলাহাট থেকেই ইতিহাসের ‘পাল’ আমলের তামা’র লিপি সর্বপ্রথম উদ্ধার করা হয়েছিল। নয্য, গুপ্ত, পাল, সেন, সূর, সুলতানি, মোঘল সর্বশেষ ইংরেজ আমলের নিয়ম, সাক্ষী এবং সভ্যতার ধারক-বাহক হিসেবে কিছু কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে ইতিহাস। আম, রেশম, মাছ আর ধানের জন্য সুখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সর্বকনিষ্ঠ উপজেলা ভোলাহাট।


সূত্রমতে, ৩৬২৩ মতান্তরে ৪৭৬৪ বর্গমাইল তথা ৪৭.৬৯ অথবা ১২৩.৫২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনে সোয়া লাখ মানুষের বসবাস এ উপজেলা টিতে। ভৌগোলিক বিভাজনে এককালে প্রাচীন পূনরোবর্ধন, দিনাজপুর, মালদহ, পূর্নিয়া, রাজশাহী এবং সর্বশেষ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত হয় ভোলাহাট। ১৮২৩ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভোলাহাট উপজেলাটি ভারতের মালদহ জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে ভোলাহাটের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় শিবগঞ্জ ও গোমস্তাপুর উপজেলা অবস্থিত।


এই উপজেলার প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোমুগ্ধকর। সবুজ আর সবুজে ঢেঁকে আছে পুরাটা জনপদ। উপজেলার সর্বত্রই চলাচল করলে মনে হবে প্রাচীনত্বের একটা গন্ধ যেন কোথা থেকে ভেসে আসছে। দূর থেকে দেখে মনে হবে আধুনিক ভোলাহাটের মাটিতে রুগ্ণ, অথচ তারা শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে শত শত বছরের পুরোনো মন্দিরগুলো। তাদের শরীর থেকে প্রাচীন ‘গড়িয়া’ ইটগুলো যেন খসে যেতে চাইছে। থানার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা শিব মন্দিরগুলোকে স্থানীয়রা ‘চামচিকা’ মন্দির বলে থাকে। এই প্রাচীন মন্দিরগুলোর প্রতি স্থানীয় মানুষের ও কর্তৃপক্ষের অযত্ন ও অবহেলার কারণে সকলেরই মনের ভিতর হতাশা পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রত্নসম্পদের যোগ্য প্রাচীন ইতিহাসের শক্তিশালী নিদর্শন সভ্যতার বার্তাবাহক শত শত বছরের পুরোনো এই মন্দিরগুলোর কাছে গিয়ে মনে হবে, যেন আমরা কোন গরুর গোহাল ঘরের দৃশ্য অবলোকন করছি।


শত শত বছরের পুরোনো ‘গড়িয়া’ ইটের তৈরি কারুকার্যখচিত মন্দিরগুলি আজও কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে যেন হাত বাড়িয়ে কিছু পুরোনো ইতিহাসের কথার স্বাগত জানায়। কথায় বলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝি না। সে ধরনের অবস্থা হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে। নইলে পরবর্তী প্রজন্মটিকে কোন কার্টুন ছবি অথবা কোন অ্যানিমেশন এঁকে বিভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোলাহাটের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা এই ধরনের ছিল। তাই আমাদের উচিত হবে একটু যত্নশীল হয়ে যে প্রত্নসম্পদ ভোলাহাটের যে স্থানগুলিতে বিদ্যমান রয়েছে, তার সংরক্ষণ ও যত্ন করা। সর্বোপরি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টি দেয়া।


বাপদাদার বয়সের বয়োবৃদ্ধ রৃষিকেষ রবিদাসের মুখে জানা যায়, এগুলো আমরা জন্ম থেকেই দেখে আসছি। এগুলির কোনোপ্রকার সৌন্দর্যের পরিবর্তন-পরিবর্ধন নেই। মন্দির গুলি আমার বাবা ও দাদাও একই কথা উল্লেখ করেন। হাজার বছরের পুরানা মন্দিরগুলি বর্তমান কালের সাক্ষী হয়ে ধ্বংসাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও এর আশেপাশে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি। আর এই মন্দির ঘেঁষা বসবাসরত জনসাধারণ অবজ্ঞা-অবহেলা করে বিপজ্জনকভাবে তাঁদের বসবাস অব্যাহত রেখেছে। এ ব্যাপারে স্থানীয়রা ঐ বসবাসকারীদের সাবধান করলেও কোনোই ভ্রূক্ষেপ না করে তারা বসবাস অব্যাহত রেখেছে। যার কারণে যেকোনো সময় মন্দির ধসে মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হবে বসবাসকারীদের।


মন্দিরগুলির ব্যাপারে রাজকুমার রবিদাস বলেন, আমরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী এমনিতেই কোণঠাসা হয়ে বসবাস করছি। জোর করে কাউকে কিছু বলতে পারি না। তারপরেও আমাদের ধর্ম আলাদা। ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের ভেতরে-বাইরে বসবাস করতে হচ্ছে খুব চিন্তাভাবনা করে। তাই সরকার বাহাদুরের নিকট আমাদের হিন্দু ধর্মালম্বীদের আকুল মিনতি আমাদের বাপদাদার আমলের পুরানা ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে শিবমন্দিরগুলির আশু সংস্কারের জোর দাবি জানাচ্ছি।


চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলায় ১২০০ শতাব্দীতে (১১৫৬-১২০৬) নির্মিত অতি প্রাচীন শিবমন্দিরগুলি ধ্বংসের প্রান্তে। দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত ও অবহেলায় পড়ে রয়েছে মন্দিরগুলো। ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও যথাযথ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এগুলির প্রতি সু-দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এলাকার সচেতন মহল।


বিবার্তা/মোস্তাফিজুর/এমবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com