ফসলি জমি কেটে রাতের অন্ধকারে পুকুর ভরাট!
প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:২২
ফসলি জমি কেটে রাতের অন্ধকারে পুকুর ভরাট!
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

চাঁপাইনবাবগঞ্জে আইন অমান্য করে ফসলি জমি কাটার মহোৎসব চলছে। জমির উর্বর টপ সয়েল বা উপরিভাগ কেটে নষ্ট করা হচ্ছে জমি নষ্ট করা হচ্ছে। এমনকি এসব জমি রাতের অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে ভরাট করা হচ্ছে পুকুর। স্থানীয় প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলেও বন্ধ হয় না অবৈধভাবে মাটি কাটা ও পুকুর ভরাটের মহাযজ্ঞ।


জানা যায়, গত দুই সপ্তাহ ধরে সদর উপজেলা বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের সল্লা এলাকায় ফসলি জমির টপ সয়েল বা মাটি কাটছে মাটিখেকোরা। সন্ধ্যা নামলেই এসব মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জেলা শহরের ভূতপুকুর এলাকায় থাকা বিশাল পুকুর ভরাট করতে। ২৫-৩০ টি ট্রাক্টরে করে এসব মাটি পরিবহন করতে গিয়ে নষ্ট করছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ এবং এলজিইডির পিচঢালা রাস্তা।


এছাড়াও সড়কের উপর পড়ে থাকা মাটিতে শীত ও বৃষ্টি পড়ে তৈরি হয় কাদা। ফলে যানবাহন চলাচলেও দেখা দেয় সমস্যা। হরহামেশায় ঘটে সড়ক দুর্ঘটনা। ধুলাবালির জ্বালায় অতিষ্ঠ সড়কের পাশে থাকা বাসিন্দা ও দোকানদাররা। তাদের দাবি, দ্রুত বন্ধ করা হোক এমন অবৈধ কর্মকাণ্ড।


চাঁপাইনবাবগঞ্জের বালিয়াডাঙ্গায় ফসলি জমি কাটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন রেজাউল করিম নামের এক ব্যক্তি। এই মাটি নিয়ে এসে পুকুর ভরাট করেন আরেক ব্যক্তি আব্দুস সালাম। জানা যায়, এসব পুকুর ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ফসলি জমি কাটার অপরাধে গত তিনদিন পূর্বে (২৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপরেও বন্ধ হয়নি মাটি কাটা ও সেই মাটি দিয়ে পুকুর ভরাট।


এনিয়ে রেজাউল বলেন, জরিমানা করলেই কী করব, এর আগেও জরিমানা করেছে। কিন্তু আমাদের কাজ চলমান থাকে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এসব করতে হয়।


পুকুর ভরাটের মূলহোতা আব্দুস সালাম গণমাধ্যমকে বলেন, জরিমানা করলেও কিছু করার নাই। এভাবেই কাজ চালিয়ে যেতে হয়। ফসলি জমির টপ সয়েল কাটা ও পুকুর ভরাট বেআইনি, তা জানেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রশাসন অভিযান করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করার দিনেও আমরা গাড়ি চালিয়েছি। জেলা শহরে এতো বড় কাজ এমনি এমনি কি আর হয়? সব পক্ষকে ম্যানেজ করেই করতে হয়।


উত্তরাধিকার সূত্রে পুকুরের অন্যতম অংশীদার মো. রকি জানান, জরিমানা বা পুকুর ভরাট আইনানুগ কি না তা আমার জানা নেই। তবে আমরা আব্দুস সালামকে পুকুর বাইনামা করে দিয়েছি, সে ভরাট করে বিক্রি করে টাকা দিবে।


স্থানীয় বাসিন্দা ও ভুক্তভোগীরা জানান, প্রকাশ‍্যে এসব ফসলি জমির মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে একশ্রেণির প্রভাবশালী মহল। ফসলি জমির মাটি কেটে ভরাট করছে পুকুর, ডোবা-নালাসহ বিভিন্ন জলাশয়। এভাবেই তিন ফসলি জমির বুক চিরে ছুটে চলছে মাটি ভরাট করা ট্রাক্টর। বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন ফসলী জমিতে এখন চলছে মাটিকাটার মহাৎসব। তিন ফসলি কৃষি জমি পরিনত হচ্ছে পতিত ভূমিতে। এতে দিন দিন ফসলের উৎপাদন কমছে, বেকার হচ্ছে কৃষক, পরিবেশ হচ্ছে দূষিত।


বালুগ্রাম এলাকার এক ব্যক্তি জানান, বিস্তীর্ণ ফসলি জমির মাঝখান থেকে অত্যাধুনিক ভেকু মেশিন দিয়ে জমির মাটি কাটার কর্মযজ্ঞ। যেই জমির উপরিভাগে ধান বোনা হতো, সে জমিতে এখন বিশাল আকারের সারি সারি গর্ত। এছাড়াও মাটি পরিবহনে ভারী ট্রাক, ট্রাক্টর ব্যবহারে গ্রামীণ সড়ক হচ্ছে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। আইন অমান্য করে এমনি কর্মকাণ্ড চলছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বিভিন্ন জায়গায়।


আমিনুল ইসলাম নামের একজন বলেন, অতি লোভে পড়ে আবাদি জমির উপরিভাগের মাটি বিক্রি করছেন একশ্রেণির জমির মালিক। খনিজ ও জৈব উপাদান বিশেষ করে হিউমাস (জৈব কণা) সমৃদ্ধ মাটির ওই অংশ তুলে ফেলার কারণে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে। কৃষিবিদরা জানিয়েছেন, এর ফলে কয়েক বছর ওইসব জমিতে ফসলের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন হবে না। ফসলি জমির মাটি দিয়ে পুকুর, জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। এসব আইনের লঙ্ঘন।


১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত ২০০১) অনুযায়ী, কৃষিজমির টপ সয়েল বা উপরিভাগের মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এসব কাজে জড়িত ব্যক্তিদের দুই লাখ টাকার জরিমানা ও দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। পুনরায় কাজটি করলে ১০ লাখ টাকা জরিমানা আর ১০ বছরের কারাদণ্ড।


ব্যক্তি মালিকানাধীন হিসেবে রেকর্ড করা পুকুরগুলো জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ এর ২ (চ) ধারায় প্রাকৃতিক জলাধারের সংজ্ঞাভুক্ত করার নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। পরিবেশ আইন-১৯৯৫ ও জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ এর বিধান অনুসারে যেকোন জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ এবং ব্যক্তিগত পুকুর হলেও তা জলাধারের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তা ভরাট করা যাবে না।


এবিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আঞ্জুমান সুলতানা গণমাধ্যমকে বলেন, গত সোমবার ফসলি জমিতে মাটি কাটার কারণে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। পাশাপাশি পরবর্তীতে এমন কাজ না করার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুনরায় মাটি কাটার তথ্য জানা নেই। তবে আবারো মাটি কাটলে এবিষয়ে উর্ধ্বতন কর্মকতাদের সাথে আলোচনা করে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


বিবার্তা/লিটন/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com