সিনেমাকেও হার মানায় চট্টগ্রামের শাওন খুনের ঘটনা
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২২:২৫
সিনেমাকেও হার মানায় চট্টগ্রামের শাওন খুনের ঘটনা
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

বন্ধুর কাছ থেকে ক্যামেরা ধার নিয়ে বিভিন্ন ইভেন্টে ফটোগ্রাফি করতেন শাওন বড়ুয়া (২৩)। এই ফটোগ্রাফিই তার জীবনের কাল হয়েছে। সেই ক্যামেরার জন্যই একটি সংঘবদ্ধ চক্র তাকে হত্যা করেছে। যেভাবে ফাঁদে ফেলে ফটোগ্রাফার শাওন বড়ুয়াকে খুন করা হয়েছে তাতে বিস্মিত হয়েছেন পুলিশ সদস্যরাও। ওই কলেজছাত্রকে খুনের ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতারের পর হত্যাকাণ্ডের পুরো রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। সেই খুনের গল্প যেন সিনেমাকেও হার মানিয়েছে।


২৮ ফেব্রুয়ারি, বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে গ্রেফতারকৃতদের বরাতে এসব তথ্য জানিয়েছে পুলিশ।


পুলিশ বলছে, খুনিরা ওয়েডিং ফটোগ্রাফির কথা বলে প্রথমে শাওনকে ভাড়া করে। পরে নির্জন স্থানে নিয়ে তার ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ক্যামেরা বাঁচাতে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে শাওনকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।


চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার পঙ্কজ চক্রবর্তী বলেন, ক্যামেরাটি শাওনের এক বন্ধুর ছিল। তাই সে এটি দিতে চায়নি। এ জন্য ছিনতাইকারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেছিল। এতে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। তার মাথা, শরীর, উরুসহ বিভিন্ন অংশে অন্তত সাতটি ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে ঘটনাস্থলে তাকে ফেলে ক্যামেরা নিয়ে পালিয়ে যায় আসামিরা।


প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা পুলিশকে জানিয়েছে তারা মূলত বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে কাজ করা ফটোগ্রাফারদের টার্গেট করেই এ কাজ করে থাকে।


পুলিশ বলছে, পাঁচজনকে গ্রেফতারের পাশাপাশি শাওনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া একটি ডিজিটাল ক্যামেরা, একটি ক্যামেরার লেন্স, দুটি ফ্লাশ লাইট ও তিনটি ক্যামেরার ব্যাটারি উদ্ধার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল, একটি সিএনজি অটোরিকশা ও দুইটি মোবাইল উদ্ধার করা হয়।


গ্রেফতারকৃতরা হলেন চান্দগাঁও থানার পশ্চিম মোহরা এলাকার দিদারুল আলমের ছেলে ইমতিয়াজ আলম মুরাদ (২১), একই এলাকার নুরুল আবছারের ছেলে আশহাদুল ইসলাম ইমন (২৪), নুরুল আমিনের ছেলে তৌহিদুল আলম (২৩), কাপ্তাই রাস্তার মাথার মো. সেলিমের ছেলে মো. বাহার (২২) ও কুমিল্লা জেলার আবুল কাশেমের ছেলে মো. আলমগীর (৩০)।


পুলিশ কর্মকর্তা পঙ্কজ চক্রবর্তী বলেন, নগরের চান্দগাঁও থানার বাহির সিগন্যাল এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আশহাদুল ইসলাম ইমন ও মো. তৌহিদুল আলম এক সময় অন্যজনের সহকারী হিসেবে বিভিন্ন বিয়ে অনুষ্ঠানে ছবি তোলার কাজ করতেন। তাদের কাছে কোনো ডিএসএলআর ক্যামেরা ছিল না। সেজন্য একটি ক্যামেরার শখ জাগে তাদের। বিষয়টি তারা এলাকার বড় ভাই মো. বাহারকে জানান। বাহারসহ মিলে এরপর ক্যামেরা ছিনতাইয়ের ফন্দি আঁটেন। সেই পরিকল্পনায় তারা যুক্ত করেন সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক মো. আলমগীর ও মো. ইমতিয়াজ আলম মুরাদ নামে আরও দুজনকে।



তিনি জানান, শুরুতে পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ফটোগ্রাফিতে যুক্ত এমন বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজে যোগাযোগের সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে উচ্ছ্বাস বড়ুয়া নামের একটি ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করে তারা সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) রাতে একটি বিয়েতে ছবি তোলার বিষয়ে কথা বলেন। তবে ওই পেজ থেকে জানানো হয় তারা এখন ফটোগ্রাফি করেন না, সেখান থেকে জনি বড়ুয়া নামের এক ফটোগ্রাফারের মোবাইল নম্বর দেয়া হয়। তবে জনি বড়ুয়ার অন্য কাজ থাকায় তিনি শাওন বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজটি করবেন কিনা জানান। শাওন রাজি হলে ইমন-তৌহিদুলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন জনি। এরই মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করতে মোবাইল আর্থিক লেনদেন সেবা-বিকাশে অগ্রিম ৫০০ টাকাও পাঠান ইমন-তৌহিদুল।


পুলিশ কর্মকর্তা পঙ্কজ চক্রবর্তী বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী ইমন ও তৌহিদুল সোমবার রাত ৮টা ২৫মিনিটের দিকে ফোন করে শাওনকে জানান তাকে ‘রিসিভ’ করতে মুরাদ নামের এক ছোট ভাই বাহির সিগন্যালের ব্যাপারী পাড়ার ভাঙা পুলের মাথায় অপেক্ষা করছেন। পরে শাওন মোটরসাইকেল চালিয়ে ওই এলাকায় আসেন। এরপর মুরাদকে নিজের মোটরসাইকেলের পেছনে বসান শাওন। এসময় মুরাদ শাওনকে জানান বিয়ের অনুষ্ঠানটা অনন্যা আবাসিক এলাকা হয়ে যেতে হবে। সে অনুযায়ী শাওন গাড়ি চালাচ্ছিলেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সিএনজি অটোরিকশাচালক আলমগীর গাড়িতে করে ইমন, তৌহিদুলকে নিয়ে তাদের পেছনে পেছনে যেতে থাকেন। তবে এক পর্যায়ে ফাঁদে পড়েছেন বিষয়টি আঁচ করতে পেরে শাওন দ্রুত গাড়ি চালিয়ে অনন্যা আবাসিকের দিকে চলে যান।


তিনি বলেন, এক পর্যায়ে পকেট থেকে ছুরি বের করে মুরাদ বলে উঠেন, কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান নেই, ভালোমতো ক্যামেরাসহ ব্যাগটা দিয়ে দাও। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তিও হয়। পরে গাড়ি থামিয়ে মুরাদকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে চান। এর মধ্যে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মুরাদ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে শাওন তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যেতে চান। সুযোগ বুঝে মুরাদ শুরুতে শাওনের উঁরুতে ছুরিকাঘাত করেন। আহত অবস্থায় শাওন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে যেতে চাইলে মুরাদ মাটি থেকে উঠে শাওনের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আরও ছয়টি ছুরিকাঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর বাহারকে ফোন করে শাওনকে মেরে ফেলার বিষয়টি জানালে তিনি মোটরসাইকেল চালিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। পরে শাওনের ক্যামেরাসহ ব্যাগটি নিয়ে মুরাদসহ দুজনেই পালিয়ে যান। পরদিন মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ শাওনের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে। এরপরই ঘটনার কারণ বের করতে মাঠে নেমে পড়ে পুলিশের একটি দল।


অভিযানে অংশ নেয়া চান্দগাঁও থানার দুজন উপপরিদর্শক (এসআই) বলেন, হত্যার পর ক্যামেরা নিয়ে পালিয়ে গেলেও শাওনের মোবাইল ফোনটি নিয়ে যায়নি হত্যাকারীরা। সেই ফোনই খুনি ও পরিকল্পনাকারীদের খোঁজ পাওয়ার কাজটি সহজ করে দেয়। প্রথমে আমরা জনি বড়ুয়াকে হেফাজতে নিই। তার মাধ্যমে যে নম্বর থেকে বিকাশ করা হয় সেটি বের করি। পরে বিকাশের দোকানে গিয়ে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বের করে বিকাশে টাকা পাঠানো ইমন ও তৌহিদুলকে শনাক্ত করি। এরপর অভিযান চালিয়ে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করি। তবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় জনিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।


এই হত্যাকাণ্ডকে ‘বিরলতম’ বলেও মনে করছেন এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা। তারা বলেন, বহু সিনেমা এবং ওয়েব সিরিজ তৈরি হয়েছে হত্যার সত্য ঘটনা অবলম্বনে। আবার অনেক খুনের ঘটনা রয়েছে, যেগুলোর অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ। তবে শাওন বড়ুয়াকে হত্যার ঘটনায় হত্যাকারীরা কোনো সিনেমা বা ওয়েব থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন কিনা এখনো নিশ্চিত হইনি। তবে এটা ঠিক যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সেটি সিনেমাতেই বেশি দেখা যায়।


নিহত শাওন সাতকানিয়া উপজেলার বাজারিয়া ইউনিয়নের শীলঘাটা গ্রামের দীপু বড়ুয়ার ছেলে। তিনি নগরীর নাসিরাবাদের ওমরগণি মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি (এমইএস) কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। পাশাপাশি তিনি ওয়েডিং ফটোগ্রাফির কাজ করতেন। নগরের বহদ্দারহাটে থাকতেন শাওন। এই খুনের ঘটনায় নিহতের বাবা টিপু বড়ুয়া বাদী হয়ে চান্দগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।


বিবার্তা/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com