শিরোনাম
মানিকগঞ্জে অজ্ঞাত রোগে ২ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৮
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০১৬, ১২:৫৮
মানিকগঞ্জে অজ্ঞাত রোগে ২ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৮
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

মানিকগঞ্জে অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত একই পরিবারের দুজনের মৃত্যু হয়েছে, বাকি আটজন চিকিৎসার অভাবে অচল ও পঙ্গু হয়ে এখন মৃত্যু পথযাত্রী। পেটে খাবার নেই, পরনে নেই কাপড়, চিকিৎসা করার মত নেই কোনো সামর্থ্য। বিনা চিকিৎসায় মরতে বসেছিল তারা।


অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে স্থানীয় একাধিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের পর অবশেষে চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন সিভিল সার্জন এবং সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক, ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল ও শিবালয় উপজেলা চেয়ারম্যান।


জানা গেছে, মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের মৃত আলতামুদ্দিনের দিন মুজুর ছেলেদের পরিবারে একদিকে অভাব-অনটন, অপরদিকে রোগব্যাধি লেগেই আছে। ফলে একবেলা খেয়ে দু’বেলা না খেয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে তারা। কোনো আশা বা ভরসা নেই তাদের বরং তাদের সামনে অপেক্ষা করছিল বিনা চিকিৎসার পরিবারের সদস্যের অসহায় মৃত্যু। একটি পরিবারের আটসদস্য প্রতিবন্ধী হলেও কপালে জোটেনি প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড।



এছাড়া সরকারি-বেসরকারি কোনো সাহায্যই জোটেনি তাদের ভাগ্যে। চার ছেলে এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে এক সময় আলতামুদ্দিনের সুখের সংসার ছিল। নিজেরাই আবাদ করতেন নিজেদের আট পাখি কৃষি জমি এবং গোয়ালে ছিল গরু। এসবই এখন এ পরিবারের কাছে শুধুই স্মৃতি।


১৯৯৮ সালে আলতামুদ্দিন মারা যান আর তার ১৩ বছর আগেই মারা যান তার স্ত্রী। আলতামুদ্দিনের মৃত্যুর দুই বছর আগে তার তৃতীয় ছেলে জামাল অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এ সময় হতেই পরিবারের অন্য সদস্যরাও ওই রোগে আক্রান্ত হতে থাকে এবং কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে। জামালের দুই বছরের একটি মেয়েও মারা যায় অজ্ঞাত রোগে। পরে তার স্ত্রী স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাবার বাড়িতে চলে যায়।


পর্যায়ক্রমে আক্রান্ত হয় আলতামুদ্দিনের বড় ছেলে আনছার আলী (৭০), ছোট ছেলে হেকমত আলী (৪৭), আনছার আলীর বড় ছেলে মনোয়ার হোসেন (৩২), ছোট ছেলে বাবুল (২৭), হেকমতের বড় ছেলে জহিরুল (১৬) ও ছোট ছেলে জাহিদুল (৮)। আলতামুদ্দিনের দ্বিতীয় ছেলে মো. আবদুর রহমান (রহম) রোগের ভয়ে একটু দূরে গিয়ে বাড়ি করলেও তার দুই মেয়ে রিনা (২০)ও রুমা (১৮) রোগের হাত হতে রেহাই পায়নি।


আনছারের স্ত্রী ময়ুর জান (৬০) বলেন, প্রথমে আমার স্বামী, দেবর ও ছেলেরা ভালই ছিল। একটু করে বয়স বাড়ার সাথে সাথেই রোগে আক্রান্ত হতে থাকে। টাকার অভাবে কি হয়েছে তা জানতে পারিনি। আমার ছোট দেবর হেকমত অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে গেলে তার স্ত্রী জহুরা পাগল হয়ে বাবার বাড়িতে চলে যায় এবং এখনও সে পাগল। দুই ছেলের এক ছেলে আমার কাছে থাকে আর অন্যজন নানার বাড়িতে থাকে আবার মাঝে মধ্যে আসে। ছেলে দুটিই অসুস্থ। আমার বড় ছেলে মনোয়ার হোসেনের দুই মেয়ে মুক্তা (৮) ও রিক্তা (৫) এখনও সুস্থ। কিন্তু তাদের মুখে এক মুঠ ভাত তুলে দেবার কেউ নেই।


ছোট ছেলে বাবুল ২০০৬ সালে বিয়ে করার পর পরই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার পর ২০১০ সালে তার স্ত্রী শেফালি বেগম স্বামীর অসুস্থতা ও অভাবের কারণে বাবার বাড়ি চলে যায়।



ময়ুর জান আরো বলেন, জমি-জমা যা ছিল তা বিক্রি করতে করতে আমাদের এখন সবই শেষ। আয়ের কোনো পথ নেই। বাড়িতে একটি গরু আছে। তার ঘাস আমি ও আমার বড় ছেলের স্ত্রী চায়না মিলে নিয়ে আসি। আমাদের কোন প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া হয়নি।


চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে তিনি বলেন, মা মরা দেবরদের আমি পেয়েছি ছোট ছোট। নিজের সন্তানদের যেমন কোলে পিঠে মানুষ করেছি ওদেরও তেমনি করেছি। তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু আমি ওদের কোথায় ফেলে দিব। এখন তার ছেলেকেও আমারই দেখতে হয়। চকে চকে ধান কুড়িয়ে, একটু আকটু কাজ করে আমি আর বড় ছেলের বৌ যা পারি তাই সবার মুখে তুলে দেই। কোনো বেলা খাবার দিতে পারি আবার কোনো বেলা দিতে পারি না। বড় ছেলের বৌর নামে একটি মাসিক কার্ড আছে, তা থেকে ৩০ কেজি করে চাল পাই। শুনেছি সরকার অনেক সাহায্য দেয়, চিকিৎসা করে কিন্তু আমাদের দিকে কি একটুও তাকাবে না?


ইউপি সদস্য মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, এই পরিবারের চেয়ে আর কোনো অসহায় পরিবার এলাকায় নেই। আমি নতুন নির্বাচিত হয়েছি তবে আমি সাধ্যমত তাদের সাহায্য করবো। কিন্তু চিকিৎসা করা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।


অন্যদিকে শিবালয় উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না তবে আমি খুব দ্রুতই স্বাস্থ্যবিভাগের লোক পাঠিয়ে তাদের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো।


একই পরিবারের আটজন অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু পথযাত্রী শিরোনামে স্থানীয় একাধিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের পর সিভিল সার্জন ডা. মো. ইমরান আলী বৃহস্পতিবার দুপুরে ছুটে যান প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল রঘুনাথপুর আলতামুদ্দিনের বাড়িতে। সিভিল সার্জন তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন।


বৃহস্পতিবারই তিনি পাঁচজন ডাক্তারের সমন্বয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেন। মেডিক্যাল বোর্ডে সদস্যরা হলেন সিনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারি ডা. জাহাঙ্গীর মো. সরোয়ারকে সভাপতি, হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. মো. লুৎফর রহমানকে সদস্য সচিব করা হয়। বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন সিনিয়র কনসালটেন্ট মেডিসিন ডা. সাকিনা আনোয়ার, সিনিয়র কনসালটেন্ট অর্থো-সার্জারি ডা. মো. আমিনুর রহমান ও সিনিয়র কনসালটেন্ট গাইনি ডা. হাজেরা শিরিন হক।


শনিবার সকাল ৯টার দিকে মানিকগঞ্জ ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সে রোগীদের গ্রামের বাড়ি থেকে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে আনা হয়।


সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মেডিক্যাল বোর্ড বসে সরকারি হাসপাতালেই তাদের বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।


পরীক্ষার ফলাফল ও রোগ সম্পর্কে কখন জানা যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে বোর্ডের সদস্য সচিব ডা. মো. লুৎফর রহমান বলেন, আগামী তিনদিনের মধ্যেই আমরা বলতে পারবো।


এদিকে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস তাদেরকে দেখতে ছুটে আসেন সদর হাসপাতালে। মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, সিভিল সার্জন, রোগী, প্রশাসনের অন্য কর্মকর্তা, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের এমডি, সাংবাদিকসহ সবাইকে নিয়ে আলোচনা করেন জেলা প্রশাসক রাশিদা ফেরদৌস।


এ সময় তিনি বলেন, আজ থেকে এই পরিবারের সংসার চালানোর দায়িত্ব আমি নিলাম। আমার মনে হয়, তাদের পুষ্টিরও মারাত্মক অভাব রয়েছে। তাদের প্রতিদিন একটি করে ডিম ও দুধ দেয়া হবে। তাদের অন্য চাহিদাও পূরণ করা হবে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হবে বলে তিনি জানান।


বিবার্তা/সুমন/জেমি/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com