শিরোনাম
রাজশাহীতে নোট-গাইডের রমরমা বাণিজ্য
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৯:৫০
রাজশাহীতে নোট-গাইডের রমরমা বাণিজ্য
রিমন রহমান, রাজশাহী
প্রিন্ট অ-অ+

সরকার অনেক আগেই নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধ করেছে। উদ্দেশ্য- মূল পাঠ্যবই পড়েই যেন শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে পারে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এ নিষেধাজ্ঞার পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষানগরীতে প্রকাশ্যে চলছে নিষিদ্ধ এই গাইড বইয়ের রমরমা বাণিজ্য। শিক্ষার্থীরা বলছে, স্কুল থেকে তাদের গাইড বই কিনতে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। আর বই ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদা থাকায় তারা গাইড বই বিক্রি করছেন।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে জানুয়ারি মাসের শুরু থেকেই রাজশাহী মহানগরীর বইয়ের দোকানগুলো অবৈধ নোট গাইডে সয়লাব হয়ে গেছে। সোনাদীঘি, নিউমার্কেটসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকার বইয়ের দোকানে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় প্রকাশ্যে বেচাকেনা চলছে নিষিদ্ধ এসব গাইড বই। জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে প্রকাশ্যে বেচাকেনা হলেও কোনো তৎপরতা নেই কারও।


নগরীর সাগরপাড়া এলাকার জুলফিকার আলীর মেয়ে তুলি খাতুন নগরীর একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে। বৃহস্পতিবার সকালে নগরীর নিউমার্কেটে মেয়ের জন্য গাইড কিনতে এসেছিলেন জুলফিকার আলী। তিনি বলেন, ‘নিজের ইচ্ছাতে কিনছি না। স্কুল থেকেই গাইড বই নিতে বলেছে। তাহলে নাকি সমাপনী পরীক্ষা ভালো হবে।’


নগরীর রায়পাড়া এলাকার মমতাজ বেগমের ছেলে নগরীর একটি নামী স্কুল থেকে এবার জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় অংশ নেবে। বৃহস্পতিবার রাতে সোনাদীঘি মোড়ে ছেলের জন্য গাইড কিনতে এসেছিলেন মমতাজ বেগম। তিনি বলেন, ‘গাইড বই নিষিদ্ধ আমরা সবাই জানি। তারপরও স্কুল থেকে এসব বই কিনতে বলা হচ্ছে। বাধ্য হয়ে কিনছি। গাইড পড়ে যদি আরেকজনের ছেলে ভালো করে, তাহলে আমার ছেলে কেন পিছিয়ে থাকবে!’


সোনাদীঘি মোড়ের একজন বই বিক্রেতা বলেন, গাইড বই নিষিদ্ধ ঘোষণার পর থেকে বইয়ের ব্যবসা পুরোপুরি শিক্ষকদের হাতে চলে গেছে। এখন শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের যে গাইড কিনতে বলেন, সেটিই চলে। এ বছরও তাই হয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের গাইডের ব্যাপক চাহিদা। আর চাহিদার শীর্ষে রয়েছে লেকচার, পাঞ্জেরী, জুপিটার, গ্যালাক্সি ও পপি পাবলিকেশনসের গাইড বই। শিক্ষকরাই এসব বই পড়তে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করছেন। বিনিময়ে তারা প্রকাশনা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কিছু সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেন।


শিক্ষকদের ‘সুবিধা’ নেয়ার বিষয়টি কীভাবে জানলেন-এমন প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিটি প্রকাশনীর সেলসম্যান বা প্রতিনিধি ‘কাজ’ করছেন। তারাই এসব জানিয়েছেন। এখন শিক্ষকরাই প্রকাশনা সংস্থার প্রতিনিধির কাছ থেকে নোট-গাইডের সৌজন্য কপি চেয়ে নেন। আর সৌজন্য কপির পাশাপাশি যে প্রকাশনা সংস্থা শিক্ষকদের আরও বেশি সুবিধা দেয়, সে সংস্থার বই-ই চাহিদার শীর্ষে চলে যায়।


নগরীর বেশকিছু বইয়ের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির নিষিদ্ধ বিভিন্ন নোট-গাইড প্রকাশ্যে বিক্রয় করছে অনেক বই বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। অষ্টম শ্রেণির পাঞ্জেরী প্রকাশনীর এক সেট সৃজনশীল গাইডের দাম ৮০০ টাকা, জুপিটার ৭০০, লেকচার সিরিজের এক সেট ৮৮০, অনুপম এক সেট ৭৮০ টাকা। বই কিনতে অভিভাবকদেরও ভিড় লক্ষণীয়।


নিষিদ্ধ এসব গাইড বই বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির রাজশাহী জেলার সভাপতি উত্তম কুমার তলাপাত্র বলছেন, ‘বর্তমানের সৃজনশীল পড়াশোনার কারণে গাইড ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী পড়তে পারবে না। শিক্ষকদেরও পড়ানো কঠিন। সবার বাড়িতেই এসব বই প্রয়োজন। প্রচণ্ড চাহিদার কারণেই এসব গাইড বই বিক্রি করতে হচ্ছে।’


তিনি বলেন, ‘সৃজনশীল সহায়ক এসব বইয়ের অনুমোদন নেয়ার জন্য গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে সরকার নির্দেশনা দেয়। কিন্তু এতো স্বল্প সময়ের মধ্যে অনুমোদন নেয়া সম্ভব না। তাই এবার অনুমোদন ছাড়াই বই বিক্রি করতে হচ্ছে। বই বিক্রি না করলে শিক্ষার্থীরাই আন্দোলন শুরু করবে। তবে আগামি বছর অনুমোদন নেয়া হবে। তখন এসব বইকে আর কেউ অবৈধ বলতে পারবে না।’


তবে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের উপ-পরিচালক আকবর হোসেন বলেছেন, যারা নোট-গাইড পড়ে স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় পাস করছে, তাদের জন্য এসএসসি পরীক্ষায় পাস করা খুব কঠিন হবে। কারণ এসএসসি পরীক্ষার সব প্রশ্নই বোর্ডের বই থেকে করা হয়। গত দুই বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেসব পরীক্ষার্থীর ফল খারাপ হয়েছে, তারা নোট-গাইডের ওপর নির্ভরশীল ছিল।


উল্লেখ্য, সরকার ১৯৮০ সালে নোট ও গাইড প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। পরে ২০০৭ সালে ১০ ডিসেম্বর উচ্চ আদালত পুনরায় জেলা প্রশাসকদের নোট গাইড বই বাজারজাত বন্ধের জন্য নির্দেশ দেন। এরপর বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রয় সমিতির করা রিটের শুনানিতে ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত প্রথম থেকে অস্টম শ্রেণি পর্যন্ত নোট গাইড মুদ্রণ, প্রকাশনা, বিক্রয় ও বাজারজাতকরণ পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তাছাড়া ২০১৩ সালের খসড়া শিক্ষা আইনেও এসব নোট ও গাইডকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।


কিন্তু এরপরেও নগরীতে নিষিদ্ধ এসব গাইডের ছড়াছড়ি কেন জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা অফিসার রফিকুল ইসলাম বলেন, এখনও পর্যন্ত তিনি সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনায় পাননি। এ জন্য গাইড বই বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে তিনি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে সরকারি আদেশের কোনো কাগজই আসেনি। আমি কিসের ভিত্তিতে অভিযান চালাবো? বই বিক্রেতারা তো আমাকে প্রশ্ন করবে আপনি কোন ক্ষমতায় এখানে এসেছেন? তবে গাইড বই পড়তে শিক্ষার্থীদের অনুৎসাহিত করার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকদের নির্দেশনা দিয়েছি।’


তবে এ ব্যাপারে রাজশাহীর একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, অধিকাংশ হাই স্কুলের শিক্ষকদের কাছেই বর্তমান সময়ের সৃজনশীল পদ্ধতিতে মূল বই পড়ানো বেশ কঠিন। এ কারণে শিক্ষকরা নোট-গাইডের প্রতি বেশি আগ্রহী। কারণ, সৃজনশীল পদ্ধতি আয়ত্ব করতে শিক্ষকদের ছয় মাস প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কিন্তু শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে তিন দিন করে। এ কারণে শিক্ষকরা ক্লাসে যাওয়ার আগে নোট-গাইড পড়ে যান। আর তারা যে গাইড বই অনুসরণ করেন, ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষার্থীদেরও ওই গাইড অনুসরণের পরামর্শ দেন।


এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের রাজশাহী অঞ্চলের উপ-পরিচালক ড. শরমিন ফেরদৌস চৌধুরী বলেন, ‘নোট-গাইডের ব্যবসা বন্ধে নজরদারির কথা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। এই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করার জন্য এনসিটিবি দেশের সব জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছে। চিঠি গেছে পুলিশের কাছেও। উচ্চ আদালতও জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছেন। এখন তারা কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন তা বলতে পারবো না।’


জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) পারভেজ রায়হান বলেন, ‘মাত্রই নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হলো। স্কুলে স্কুলে বই বিতরণের ব্যস্ততা ছিল। তাই বইয়ের দোকানে নজর দেয়া যায়নি। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আমি আলোচনা করবো। তারপর তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে অচিরেই নিষিদ্ধ গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবো।’


রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) মুখপাত্র সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইফতেখায়ের আলম বলেন, নিষিদ্ধ গাইড বইয়ের ব্যাপারে অভিযান চালানোর ব্যাপারে সরকারি কোনো নির্দেশনা এসেছে কী না তা তার জানা নেই। তবে এ ব্যাপারে শিক্ষাবোর্ড বা সংশ্লিষ্টরা পুলিশের সহযোগিতা চাইলে তা করা হবে।


বিবার্তা/রিমন/পলাশ


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com