শিরোনাম
বাল্য বিয়ের বলি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নুর নাহার
প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২০, ২১:৩৬
বাল্য বিয়ের বলি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নুর নাহার
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

বাল্য বিয়ের বলি হলো অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নুর নাহার (১৪)। পরিবারের অভাব অনটন আর কিশোরীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় সহপাঠিদের সাথে ছুটাছুটি করে খেলার সময়েই তাকে বসতে হয় বিয়ের পিড়িতে। মাস খানেক আগেই লাল শাড়ি আর মেহেদী পরে বিয়ের সাঁজে সেজে শ্বশুরবাড়ি যায় নুর নাহার।


এরপরও পরিবারের অভাব অনটন আর কিশোরীর উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনাই যেন কাল হলো তার। বিয়ের মাত্র ৩৪ দিনের মাথায় টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার ফুলকি পশ্চিমপাড়া গ্রামে ঘটনাটি ঘটে।


নিহত নুর নাহারের স্বামীর বাড়ির পক্ষ থেকে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসার প্রস্তাব দেয়া হলেও আইনি প্রক্রিয়ায় এর বিচার না হলে বাল্যবিয়ের বলি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নুর নাহারের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে না বলে দাবি এলাকার সচেতন মহলের।


নিহতের পরিবার সূত্রে জানা যায়, নুর নাহারের বাবা সখীপুর উপজেলা নলুয়া কলাবাগান গ্রামের বাসিন্দা ও রিকশাচালক আর মা গার্মেন্টস কর্মী। অভাবের সংসারে তার বাবা মায়ের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া লেগেই থাকতো। এ কারণে দিনমজুর উপজেলার কাউলজানী ইউনিয়নের কলিয়া গ্রামের বাসিন্দা নানা লাল খান চার বছর বয়সে নুর নাহারকে তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর তাকে স্কুলে ভর্তি করান। এ বছর নুর নাহার কলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছিল।


গত ২০ সেপ্টেম্বর উপজেলার ফুলকি পশ্চিমপাড়া গ্রামের আব্দুর রশিদের ৩৪ বছর বয়সী ছেলে ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ফেরত রাজিব খানের সঙ্গে বিয়ে হয় মেয়েটির। বিয়ের সময় নানা লাল খানের প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। এই টাকার জোগান দেন তার আত্মীয়-স্বজনরা। তবে মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায় তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি হয়নি। অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হওয়ায় আর দাম্পত্যের মিলনের পর থেকেই শুরু হয় তার যৌনাঙ্গে রক্তক্ষরণ। রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে নুর নাহার ও রাজিবের পরিবারে আলোচনা হয়। পরে রাজিবের পরিবারের পক্ষ থেকে গ্রাম্য কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। এতেও ফল না পাওয়ায় গত ২২ অক্টোবর নুর নাহারকে ভর্তি করা হয় টাঙ্গাইলের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে।


ওই ক্লিনিকে নুর নাহারকে তার পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে স্বামী রাজিব ও তার পরিবার কৌশলে সেখান থেকে কেটে পড়ে। পরে অবস্থার অবনতি হলে নুর নাহারের পরিবার তাকে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় মেয়েটির চিকিৎসা করানোর মতো টাকাও ছিল না গরিব পরিবারটির হাতে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় গ্রামবাসী প্রায় ৬০ হাজার টাকা তুলে দিলে উন্নত চিকিৎসার জন্য নুর নাহারকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে তার পরিবার।


কিশোরী নববধূর এমন দুঃসময়েও শ্বশুরবাড়ির কোনো লোকই ছিলোনা পাশে। অবশেষে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার (২৪ অক্টোবর) রাতে মৃত্যু হয় তার। পরদিন রবিবার (২৫ অক্টোবর) ময়নাতদন্ত শেষে তাকে তার নানার বাড়ির কবরস্থানে দাফন করা হয়।


নুর নাহারের নানা লাল খান বলেন, মেয়ের জামাইয়ের অভাবের কারণে নাতনি নুর নাহারকে ছোটবেলাতেই আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। দিনমজুরি করেও তাকে লেখাপড়া করাচ্ছিলাম। ছেলে প্রবাসী ও ধনী হওয়ায় মেয়েটির সুখের কথা ভেবে আমরা নুর নাহারকে বিয়ে দেই। বিয়ের কয়েকদিন পর থেকে তার রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এ জন্য নুরনাহারের শাশুড়ি তাকে গ্রাম্য কবিরাজের ওষুধ খাওয়াচ্ছিল। পরে রক্তক্ষরণ বেশি হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তাররা বলেছেন, অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে ও অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের কারণে নুর নাহারের রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা তাকে আর বাঁচাতে পারলাম না। মৃত্যুর পর নুর নাহারের স্বামী রাজিব তার লাশটি পর্যন্ত দেখতে আসেনি। মূলত স্বামীর কারণেই আমার নাতনির মৃত্যু হয়েছে বলেই দাবি করেন তিনি।


এদিকে নুর নাহারের স্বামী রাজিব খান, শ্বশুর, শাশুড়িসহ বাড়ির লোক জনের দাবি আগে থেকেই মেয়েটির জরায়ুতে (টিউমার) সমস্যা ছিলো। মেয়ের অসুস্থতা গোপন করে বিয়ে দিয়েছে। তার পরেও আমরা চিকিৎসার কোনো কৃপনতা করি নাই। ক্লিনিকের ডাক্তার যখন ঢাকা রেফার্ড করলেন। তখন নুর নাহারের পরিবারকে জানানো হয়। তারা এসে ঢাকা নিয়ে যায়। পরে ঢাকা যেতে চাইলে তারা নিষেধ করে। পরে মৃত্যুর সংবাদ শুনে বাড়ির গেলে ওই বাড়ির লোকজন আমাদের সাথে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করেন। এমনকি আমার ছেলে (নুর নাহারের স্বামী) রাজিবকে মারধর করে বাড়ি থেকে তারিয়ে দেয়। ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের নিকট ঘটনাটি জানালে তিনি আমাদের বাড়িতে চলে আসতে বললে আমরা বাড়ি চলে আসি।


কাউলজানী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, স্বামী পরিবারের লোকজন আমার কাছে অভিযোগ করেন স্ত্রী মৃত নুর নাহারের বাড়িতে তাদের যেতে দেয়া হচ্ছে না। পরিবেশ অস্বাভাবিক না হওয়ার জন্য আমি তাদের ওই বাড়িতে যেতে বাড়ন করি। এছাড়াও তাদের মারধর করা হয়েছিল সে বিষয়টি তারা তাকে বলেন।


কলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, আমরা নিয়মিতই শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর নিয়ে থাকি। হঠাৎ করেই গোপনে নুর নাহারকে তার পরিবার বিয়ে দিয়ে দেয়। নুর নাহার মেধাবী ছাত্রী ছিল। অষ্টম শ্রেণিতে তার রোল নম্বর ছিল ২। নুর নাহারের মৃত্যুর সংবাদটি খুবই দুঃখজনক। আমরা একজন মেধাবী ছাত্রীকে হারালাম। এমন আর কোনো নুরনাহার যেন বাল্য বিয়ের বলি না হয়।


নুর নাহারের মামা লুৎফর খান বলেন, বিষয়টি থানা পুলিশকে জানানো হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।


বাসাইল থানার ওসি হারুনুর রশিদ বলেন, এ ঘটনায় কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।


এ প্রসঙ্গে বাসাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামছুন নাহার স্বপ্না বলেন, বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে অষ্টম শ্রেণির একজন ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। শুধু আইন দিয়ে নয়, সামাজিকভাবে বাল্যবিয়ে নির্মূল করতে হবে।


বিবার্তা/তোফাজ্জল/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com