শিরোনাম
যেভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠে প্রতারক সিকদার লিটন
প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২০, ১৮:২৫
যেভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠে প্রতারক সিকদার লিটন
আলফাডাঙ্গা প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার টগরবন্দ ইউনিয়নের চর আজমপুর গ্রামের সিদ্দিক শিকদারের ছেলে সিকদার লিটন ওরফে টুটুল ওরফে সুমন। স্থানীয়দের কাছে তিনি প্রতারক ও ছদ্মবেশী অপরাধী বলেই বেশি পরিচিত।


স্থানীয়রা জানিয়েছে, স্থানীয়দের কাছে লিটন প্রতারক ও ছদ্মবেশী অপরাধী বলেই বেশি পরিচিত। এলাকার মানুষকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। চাকরি তো দূরের কথা, টাকা চাইতে গেলে প্রাণনাশের হুমকি দেন। এসব অপরাধের অভিযোগে একাধিক মামলাও আছে তার বিরুদ্ধে। এসব কারণে আলফাডাঙ্গা ও টগরবন্দ থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়। এরপর রাজধানী ছাড়াও খুলনার সীমান্ত এলাকা, পাবনাসহ বিভিন্ন জায়গা অবস্থায় নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে আস্তানা গেড়েছেন।


স্থানীয়রা আরো জানিয়েছে, বিভিন্ন সময় সিকদার লিটন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়েছেন। বিশেষ করে- আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক এমপি মো. আব্দুর রহমান, আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম আকরাম হোসেন, আলফাডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সাইফারের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুৎসা রটান। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে থানায় সাইবার অপরাধে মামলাও হয়েছে।


জানা গেছে, আলফাডাঙ্গা, নড়াইল, পাবনা, খুলনা, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় একেক সময় অবস্থান করে কখনো সাংবাদিক, কখনো বড় রাজনৈতিক নেতাদের খুবই কাছের লোক পরিচয় দিয়ে বিভিন্নজনকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার নাম করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই প্রতারক সিকদার লিটন। যখনই কোনো সমস্যা হতো তখনই অবস্থান পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় অবস্থান করতো এই প্রতারক। অবস্থান পরিবর্তন করে আবার শুরু করতো সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা।


২০১৮ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন-বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি দেয়ার আশ্বাসে দুই লাখ টাকা নেয় প্রতারক সিকদার লিটন। দুই বছরেও চাকরি কিংবা টাকা কিছুই ফেরত পাননি ভুক্তভোগী নাজমুল। টাকা চেয়ে দীর্ঘদিন লিটনের কাছে ধর্ণা দিলেও টাকা তো দূরের কথা এখন উল্টো হুমকি দেওয়া হচ্ছে তাকে। গরু ও কিছু জমি বন্ধক রেখে লিটনের হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলেন নাজমুল। বর্তমানে অসহায় হয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন এই যুবক।


ভুক্তভোগী নাজমুল বলেন, চাকরি দেয়ার নামে প্রতারক সিকদার লিটন দুই লাখ টাকা নেয় তার কাছ থেকে। কিন্তু আড়াই বছর হয়ে গেলেও তাকে চাকরি কিংবা টাকা কোনোটাই ফেরত দেয়া হয়নি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনে (বিআইডব্লিউটিসি) চাকরি দেয়ার কথা বলে লিটন দুই লাখ টাকা নেয়। সরকারি চাকরির চিন্তা করেই টাকা দিয়েছিলাম। ভাবলাম যদি চাকরিটা হয় তাহলে আমার জন্য ভালো হয়। এখন ফোন দিলে উল্টাপাল্টা কথা বলে। আবার অনেক সময় কল দিলে ধরে না। ওর (লিটনের) সঙ্গে আরো কয়েকজন লোক আছে ওর গ্রামের। তারা মিলে আমার মতো আরো অনেকের টাকা মেরে দিয়েছে।



নাজমুল বলেন, লিটনের নামে কয়েকজনের কাছে অভিযোগ দিতে গিয়েছি, কেউ ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনে না। কারণ ওর সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বললে ও (লিটন) সেগুলো রেকর্ড করে নেটে ছেড়ে দেয়। এজন্য কেউ কথা বলতে চায় না।


নাজমুল আরো বলেন, প্রতারক লিটন আলফাডাঙ্গা গ্রামে আসে না। আলফাডাঙ্গা থানায় অভিযোগ দিতে গিয়ে শুনি ওর নামে আরো বহু অভিযোগ রয়েছে। আমাকে থানার ওসি বললেন, সে তো (লিটন) গ্রামে আসে না। এলে আমরা একটা ব্যবস্থা নিতে পারতাম।


চাকরির আশ্বাসে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কাছ থেকে নগদ টাকা ও মোবাইলফোন হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক সিকদার লিটন। এভাবে বহু মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন তিনি। এমন কোনো অপরাধ নেই, যার সঙ্গে জড়িত না লিটন।


মুক্তিযোদ্ধা আ. হালিম মিয়া বলেন, বেশকিছু দিন আগের ঘটনা। তখন আমার মেয়ের নতুন বিয়ে হয়েছে। জামাইসহ থাকত ঢাকার সাভারে। জামাই বেকার ছিল। হঠাৎ একদিন সিকদার লিটন ওদের বাসায় যায়। লিটন বলে, ভাই (জামাইকে) আপনার তো চাকরি-বাকরি নেই বেকার মানুষ, দেখি একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারি কি-না। এতে জামাই লিটনের কথায় আশ্বস্ত হয়। এ সময় লিটন চাকরির জন্য কিছু টাকা দাবি করে। কথা অনুযায়ী টাকাও দেওয়া হয়।


হালিম মিয়া আরো বলেন, টাকা নেওয়ার পর প্রতারক লিটন আমার জামাইকে বলে- দেখি ভাই আপনার মোবাইলটা একটু দেন। চাকরির খবর নিই। এই বলে মোবাইল নিয়ে বাইরে কথা বলতে বলতে বের হয়ে আসে। এরপর কোনোদিন টাকা বা মোবাইল ফেরত তো দেয়নি, চাকরিরও কোনো ব্যবস্থা হয়নি।


এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘এরপর আমি যখন চেয়ারম্যান নির্বাচন করলাম তখন ও (লিটন) এলো। আমার সঙ্গে ৭-৮ দিন থাকলো। এরপর চলে গেল। টাকা চাওয়ার পরেও আর টাকা দেয়নি। এরপর থেকেই তো ফেরারি।


এদিকে প্রতারক সিকদার লিটনের আরেক প্রতিবেশী সামীম শেখ বলেন, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকরির কথা বলে লিটন অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। সে এলাকায় চাঁদাবাজির সঙ্গেও জড়িত ছিল। স্থানীয়রা একদিন ক্ষিপ্ত হয়ে জোড়া মান্দার গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখে। পরে মুরব্বিদের হাতে পায়ে ধরে রক্ষা পায়। এরপর থেকে এলাকা ছাড়া। কিন্তু তারপরেও দমেনি। এখনও বিভিন্ন জায়গায় শোনা যায় তার প্রতারণার গল্প।


মুক্তিযোদ্ধা আ. হালিম মিয়া ও সামীম শেখ দুজনই সিকদার লিটনের প্রতিবেশী। তাদের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার টগরবন্দ ইউনিয়নের চর আজমপুর গ্রামে। পাশের বাড়ির প্রতিবেশী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই চেনেন প্রতারক লিটনকে। আর স্থানীয়দের কাছেও তিনি প্রতারক ও ছদ্মবেশী অপরাধী বলেই বেশি পরিচিত।


প্রতিবেশী সামীম শেখ বলেন, এলাকা থেকে বিতারিত হওয়অর পর পাবনা, খুলনা, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গা অবস্থান করেছে এই প্রতারক। সেখানেও মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এত অত্যাচার আল্লাহ সহ্য করলেও মানুষ সহ্য করে কেমন করে?


'কিছুদিন আগে নড়াইল থেকে একজন মহিলা এসে কান্নাকাটি করছিল। পরে জানতে পেরেছি লিটন তাকে বিদেশ পাঠানোর কথা বলে এক লাখ বিশ হাজার টাকা নিয়েছে। এমন অনেক খারাপ কাজে জড়িত লিটন।


সামীম বলেন, স্থানীয় অনেক ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনায় লিটন জড়িত। আবার মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়ার ঘটনায় অনেকে এখনও তার বাড়িতে আসে। বাবা-মা মারা যাবার পরেও দাফন করতে এলাকায় আসতে পারেনি।


প্রসঙ্গত, গত ১৯ অক্টোবর ভোররাতে ভাঙ্গা উপজেলা সদরে থানার কাছে একটি ভাড়া বাসা থেকে সিকদার লিটনকে গ্রেপ্তার করে ফরিদপুর র্যাব-৮। পরে ডিজিটাল অ্যাক্ট আইনে দায়েরকৃত মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে প্রতারক সিকদার লিটনকে আদালতে তোলা হলে একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।


প্রতারক সিকদার লিটন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের প্রতারণার পাশাপাশি সাইবার অপরাধের সঙ্গেও জড়িত ছিল। তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও চাঁদাবাজি মামলার চারটি গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। এসব মামলায় সে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিল।


ফরিদপুর, খুলনা ও পাবনা জেলায় চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও প্রাণনাশের হুমকি, সাইবার অপরাধসহ প্রায় ডজনখানেক মামলা রয়েছে সিকদার লিটনের বিরুদ্ধে। ফেসবুকে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে অপপ্রচার করে ব্ল্যাকমেইলিং এবং গ্রামের সহজ-সরল অনেক মানুষের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণার অভিযোগে ডিজিটাল অ্যাক্ট আইনে দায়েরকৃত মামলার আসামি লিটন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে দুই ডজনের বেশি মামলা রয়েছে।


বিবার্তা/আবদাল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com