শিরোনাম
গৌরীপুর বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি
প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২০, ১৬:৪০
গৌরীপুর বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি
গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি। ঢেঁকিতে উঠে কত গান ও কত প্রবাদ গাওয়া হতো গ্রাম্য মেয়েদের। সময় আর জীবন দুটিই বহমান নদীর মতো। জোয়ারে এক রকম আর ভাটায় ভিন্ন রকমের পরিবেশ মুহূর্তেই যেন পাল্টে যায় চিত্র।


মানুষের জীবন ও জীবনের উপাদানও চলার পথে পাল্টে যায়। তেমনিভাবে পাল্টে গেছে গ্রাম বাংলার চিত্র আর ঢেঁকি। বদলে যাচ্ছে কর্ণফুলী, প্রতিটি পাড়া মহল্লায় ভবনের পর ভবন গড়ে উঠছে।


গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় এক সময় ঢেঁকি দিয়ে চাল তৈরি, চিড়া ভাঙা, আটা, গম, জব, পায়েসের চালের গুঁড়ো, খির তৈরির চাল বানানোর সেই ঢেঁকি-আজ অসহায় হয়ে পড়েছে ইঞ্জিনচালিত মেশিনের কাছে।


কালের বিবর্তন আর আধুনিকতার ছোয়ায় গ্রাম বাংলা থেকে বিলীন হয়ে গেছে ঢেঁকি। কয়েকটি গ্রাম ঘুরেও তা দেখা মেলেনা আর। হয়তো জাদুঘরে তার স্থান হয়েছে। বর্তমান মানুষের প্রযুক্তি নির্ভরতা এবং কর্মব্যবস্ততা বেড়ে যাওয়ায় ঢেঁকির ব্যবহার নেই বললেই চলে।


চৈত্র মাস শেষে নতুন ধানের গন্ধে যখন গ্রাম বিমোহিত হতো তখনি গ্রাম্য মেয়েরা নতুন চাউলের পিঠা আর নানা খাবার তৈরিতে ব্যস্ত থাকতো। এখন আর সেদিন নেই। সব অতীত আর স্মৃতির পাতায় জমা। আগে বারো মাস ব্যবহার করা হলেও এখন ঢেঁকি শুধু বিশেষ বিশেষ সময়েও দেখা যাচ্ছে না।


বিশেষ করে শীতের সময় পৌষ মাসে ঢেঁকির ব্যবহার অন্য সময়ের চেয়ে বেশি ছিল। এক সময় ভোরে আজানের সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধতা ভেঙে চারদিকে ছড়িতে পড়তো ঢেঁকির শব্দ। পরিবারের নারীরা সে সময় দৈনন্দিন ধান, গম ও যব ভাঙার কাজ ঢেঁকিতে করতেন।পাশাপাশি চিড়া তৈরির মত কঠিন কঠিন কাজও ঢেঁকিতে করা হতো। বিশেষ করে তিন দশক আগেও কর্ণফুলীতে শবে বরাত, ঈদ, পূজা, নবান্ন উৎসবসহ বিশেষ বিশেষ দিনে পিঁঠা পুলি খাওয়ার জন্য অধিকাংশ বাড়িতে ঢেঁকিতে চালের আটা তৈরি করা হতো।


সে সময় গ্রাম্য বধুদের ধান ভাঙার গান আর ঢেঁকির ছন্দময় শব্দে চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যেত। তাছাড়া ওই সময় এলাকার বড় কৃষকেরা আশপাশের দরিদ্র নারীদের টাকা বা ধান দিয়ে ঢেঁকিতে চাল ও আটা ভাঙিয়ে নিতেন বলে ৬৫ বছর বয়সী মাওহার আলহাজ্ব আব্দুর শুক্কুর জানান।


অনেক দরিদ্র পরিবার আবার ঢেঁকিতে চাল ভাঙিয়ে হাট-বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত বলে মন্তব্য করেছেন আজিম পাড়ার ফজল আহমেদ। ঢেঁকিতে ভাঙা পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু চালের বেশ কদর ছিল সেসময়।


সভ্যতার প্রয়োজনে ঢেঁকির আবির্ভাব ঘটেছিল। আবার গতিময় সভ্যতার যাত্রাপথে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ঢেঁকি। যোগ হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য আর যন্ত্রপাতি। সময় বাঁচাতে গিয়ে এসব যন্ত্রের ওপর বাড়ছে মানুষের বাড়তি নজর। লুপে নিচ্ছে সব সুযোগ-সুবিধা।


শহরে তো বটেই, আজকাল গ্রামের ছেলে মেয়েরাও ঢেঁকি শব্দটির কথা জানলেও বাস্তবে দেখেনি। অনেকের কৌতূহল কেমন করে মেশিন ছাড়া ধান থেকে চাল বের করা হতো। আসলে ধানের তুষ ছাড়িয়ে চাল বানানোই ছিল ঢেঁকির কাজ।


তবে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের আব্দুল করিম বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, আধুনিক যুগে নিত্য নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে যেসব ফলমূল আর আটা ময়দার প্যাকেট সৃষ্টি হচ্ছে তাতে পূর্বের কোনো স্বাদ নেই। যেন রস, স্বাদ, গন্ধহীন হাইব্রিডে হারাচ্ছে খাদ্যের গুণগত মানও।’ যদিও ওনার কথার সঙ্গে অনেক যুক্তি রয়েছে। তবে তা ফেলে দেয়ার মতো না।


রামগোপালপুর ইউনিয়নের শিবপুর গ্রামের গৃহবধূ জোহরা বেগম (৫৮) বলেন, ছোটকালে আমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর থেকেই ঢেঁকি দিয়ে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য মাড়াই করছি। আমার বাপের বাড়িতে আগে প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন ঢেঁকিতে চালের আটা তৈরি করতে আসতো। কিন্তু এখন আর ঢেঁকি নেই। দেখাও যায় না কেউ আসেনও না। এখন সবাই মেশিনে চাল মাড়াই করে।


ঢেঁকি হচ্ছে কাঠের তৈরি কল বিশেষ। প্রায় ৬ ফুট লম্বা ও ৯ ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট একটি ধড় থাকে ঢেঁকিতে। মেঝে থেকে ১৮ ইঞ্চি উচ্চতায় ধড়ের একেবারে সামনে দুই ফুট লম্বা একটি গোল কাঠ থাকে। এটাকে মৌনা বলা হয়। দু’টি বড় কাঠের দণ্ডের ভেতর দিয়ে একটি ছোট হুকড়া হিসেবে কাঠের গোরাকার খির থাকে। এভাবেই তৈরি ঢেঁকি দিয়ে এক সময় ধান ভাঙ্গানোর কাজ করা হতো ব্যাপকভাবে।


কালের বিবর্তনে আধুনিক যুগে সেই ঢেঁকির জায়গা দখল করে নিয়ে বিদ্যুৎ চালিত মেশিন (ধান ভাঙ্গার চাল কল) এর মাধ্যমে মানুষ এখন অতি সহজেই অল্প


সময়ে ধান থেকে চাল পাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে বসছে চাল তৈরির কল।ঢেঁকি একটি শিল্প হলেও এ শিল্পকে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।


ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্প রক্ষায় সকলকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন গৌরীপুরের প্রবীণেরা।বিবার্তা/হুমায়ুন/এসএ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com