কুড়িগ্রামের প্রতিদিনের সংবাদ ও বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের নির্যাতনকারী হিসেবে অভিযুক্ত নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন অল্প দিনেই অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তবে তিনি এ ব্যাপারে কৌশল নিয়েছেন। তার স্ত্রী ও শ্বশুরের নামে সম্পদ কিনেছেন।
নাজিমের বাড়ি যশোরের মণিরামপুর উপজেলায়।তিনি উপজেলার কাশিপুর গ্রামের নানা বাড়িতে বড় হন।বাবা মৃত নিছার উদ্দিনের পৈত্রিক বাড়ি একই উপজেলার দুর্বাডাঙ্গা গ্রামে হলেও অনেক আগে থেকেই তিনি কাশিপুর এলাকায় শ্বশুরালয়ে ঘরজামাই থাকতেন।
যেশোর মনিরামপুরের ভগবানপাড়ায় নাজিমের নির্মাণাধীন ৪তলা বাড়ি
নাজিম উদ্দিন ২০১৪ সালে সরকারি চাকরিতে যোগদানের ৩-৪ মাস পর একই উপজেলার হোগলাডাঙা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ে সাবিনা সুলতানাকে বিয়ে করেন।আব্দুর রাজ্জাক মণিরামপুর শহরের ভগবানপাড়ায় তার নিজের বাড়িতে থাকেন। শ্বশুরবাড়ির পাশেই সাড়ে ১৪ লাখ টাকায় কেনা আট শতক জমির ওপরে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশাল চারতলা বাড়ি নির্মাণ করছেন নাজিম উদ্দিন।এছাড়া কাশিপুরে নানার দেয়া পাঁচ শতক জমির ওপর তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি একতলা বাড়ি রয়েছে তার।বাড়িটি চারটি সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত।এছাড়া এলাকায় শ্বশুরের নামে কৃষিজমিও কিনেছেন কয়েক একর।মাত্র ছয় বছরের চাকরিজীবনে কীভাবে তিনি এতো টাকার মালিক হলেন- তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এলাকাবাসীর মনে।তারা নাজিম উদ্দিনের সম্পদের উৎস খতিয়ে দেখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
নাজিমের বাবা নিছার উদ্দিন অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন তিন বছর আগে।তার আগে তিনি অনেক কষ্ট করে এমনকি ভাটায় কাজ করে ছেলেকে মানুষ করেছেন।বাবার পাশাপাশি তার মা মাজেদা বেগমও বাপের বাড়িতে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালিয়েছেন।ছেলেকে শিক্ষিত করতে তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ পর্যন্ত করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, নাজিম কাশিপুরে নানাবাড়িতে থেকে মণিরামপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন।ছোটবেলা থেকে সে খুব বদ মেজাজি আর একরোখা ছিল।গ্রামে কারো সঙ্গে ভালোভাবে মিশতেন না।২০০৪ সালে সেখান থেকে এসএসসি পাস করেন নাজিম।২০০৬ সালে মণিরামপুর সরকারি কলেজ থেকে তিনি এইচএসসি পাস করেন।তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন। লেখাপড়া শেষ করে এক্সিম ব্যাংকে চাকরি করেন কিছুকাল। ২০১৪ সালে ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথমবারেই উত্তীর্ণ হয়ে তিনি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হন।একভাই এক বোনের মধ্যে নাজিম বড়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পর থেকে নাজিম এলাকার কাউকে পাত্তা দেন না।কারণে-অকারণে মানুষকে ভয় দেখান।তার ক্ষমতার ভয়ে সবাই চুপ করে থাকেন।একই কারণে এখনো নাজিমের বিরুদ্ধে কথা বলতে গ্রামবাসী ভয় পাচ্ছিলেন।নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা কিছু তথ্য দেন।
স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা জানান, নাজিমের পরিবার আওয়ামী লীগ ভক্ত।তবে সাংবাদিককে নির্যাতন করে নাজিম উদ্দিন অন্যায় করেছেন বলে মন্তব্য করেন গোলাম মোস্তফা।
এদিকে কুড়িগ্রামে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় নাজিমের জড়িত থাকার বিষয়টি জানাজানি হলে মণিরামপুরে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এলাকায় বিষয়টি এখন সবার মুখে মুখে।
নাজিমের অর্থবিত্তের বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে জোরেসোরে। নাজিমের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়টি শুনে বিরূপ মন্তব্য করছেন এলাকাবাসী।এমনকি নাজিমের মা মাজেদা বেগমও তেমন মন্তব্যই করেছেন।
নাজিমের নির্মাণাধীন চারতলা বাড়ির ঠিকাদার আতিয়ার রহমান বলেন, ‘২০১৮ সালে হোগলাডাঙা গ্রামের মোসলেম নামে এক লোকের কাছ থেকে সাড়ে ১৪ লাখ টাকায় আট শতক জমি কেনেন নাজিম উদ্দিন ও তার প্রবাসী ভায়রা। সেখানে এক কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যে প্রতি ফ্লোরে তিন ইউনিটের চারতলা একটি বাড়ির কাজ চলছে। প্রতি তলা দুই হাজার ৯০০ বর্গফুটের।১১ মাস আগে কাজ শুরু হয়েছে। বাড়ির শ্রমিক ঠিকাদার আমি।এই পর্যন্ত ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে।’
নাজিম উদ্দিনের মা মাজেদা বেগম বলেন, ‘বউমার কাছে শুনিছি, নাজিমের চাকরির স্থানে কী একটা সমস্যা হয়েছে। বিস্তারিত জানি না।’ পরে সাংবাদিকদের কাছে কুড়িগ্রামে সাংবাদিককে নির্যাতনের বিষয়টি শুনে তিনি বলেন, ‘এটা নাজিম ঠিক করেনি।বাড়ি আসলে আমি তাকে বোঝাবো।’
নাজিমের স্ত্রী সাবিনা সুলতানা বলেন, ‘গত রবিবার মণিরামপুর বাজারে গিয়ে ঘটনাটি জানতে পারি।নাজিমকে কল করে মোবাইল বন্ধ পাচ্ছিলাম।আজ সকালে নতুন একটা নম্বরে নাজিম কল করেছে। সে বলেছে, একটু ঝামেলা হয়েছে। কোনো সমস্য না। আল্লাহর কাছে দোয়া করতে।’
নাজিম উদ্দিনের মণিরামপুর বাজারে বাড়ি করার বিষয়ে সাবিনা সুলতানা বলেন, ‘বাড়ির জমিটা আমাদের দুই বোনকে আব্বা দিয়েছেন। সেখানে আমরা দুই বোন মিলে বাড়ি করছি। আমি একটা ব্যাংক লোন নেয়ার চেষ্টা করছি। এখন খরচ আমার সেই বোন দিচ্ছেন।’
কাশিপুর গ্রামে নাজিমউদ্দিনের বাড়ি
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নানা অনিয়মের রিপোর্ট করায় গত শুক্রবার মধ্যরাতে আরিফুল ইসলামের বাড়িতে জোর করে ঢুকে তাকে তুলে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন করেন আরডিসি নাজিম উদ্দিনসহ অন্যরা। পরে তাকে মাদক রাখার কথিত অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এক বছরের সাজা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসক, আরডিসিসহ কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।
এর আগে কক্সবাজারে থাকাবস্থায় নাজিমের বিরুদ্ধে এক বৃদ্ধকে মারপিটের অভিযোগ ওঠে। কুড়িগ্রামের ঘটনার পর কক্সবাজারের সেই ভিডিও এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল।
বিবার্তা/তুহিন/জাহিদ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]