শিরোনাম
জীবনযুদ্ধে হাল ছাড়েননি টাঙ্গাইলের চা দোকানি চায়না
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২০, ১৪:৩৪
জীবনযুদ্ধে হাল ছাড়েননি টাঙ্গাইলের চা দোকানি চায়না
ছবি: মোল্লা তোফাজ্জল
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

খোলা আকাশের নীচে ছোট একটি দোকান। বৃষ্টি হলে অনেক সময় পানি গড়িয়ে পড়ে তার মাথায়। তারপরও ঠায় বসে থাকেন দোকানে। শিশু নাতনিকে কেটলির পাশেই টেবিলে ঘুম পাড়িয়ে কাজ করেন। দোকানের সামনে বসেই খাবার খান। টানাটানির সংসারে এখনো সংগ্রাম করে চলেছেন তিনি। বলছিলাম জীবনযুদ্ধে হার না মানা চা দোকানি চায়না বেগমের কথা।


টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবের সামনে খোলা আকাশের নিচে চায়নার চায়ের দোকান। চায়ের চুমুকে প্রায়ই কথা হয় চায়নার সাথে। চায়নার লম্ভা সময়টা একটি জীবনযুদ্ধের গল্প। ঘণ্টা বাজিয়ে প্রতিবছর নারী দিবস উদযাপন হলেও চায়নাদের মতো নারীদের ভাগ্যের চাকা ঘোরে না। জীবনযুদ্ধে চায়না এখন অনেকটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।


বয়স চল্লিশের কোটা পার করেছে অনেক আগেই। পিছনের পুরো সময়টা কাটিয়েছেন বেঁচে থাকার সংগ্রামে। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেটে যায় তিনবেলা খাবার জোগাড়ে।


শহরের পশ্চিম আকুরটাকুর পাড়ায় এক-কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে চায়ের দোকান চালান তিনি।


চায়নার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার সহদেবপুর ইউনিয়নের গোঁপিনাথপুর গ্রামে। চায়নার বাবা সামাদ ফকিরের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অল্প বয়সেই মধপুরের শাহজাহানের সাথে চায়নাকে বিয়ে দেয়। বিয়ের দুই বছরের মাথায় চায়নার কোলে এক মেয়ে সন্তান দিয়ে চায়নার স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মেয়ে ফাতেমাসহ পুরো সংসারের দায়িত্ব পড়ে স্বামীহারা চায়নার কাঁধে। শুরু হয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম।


গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন শহরে। সেই থেকে খোলা আকাশের নীচে চায়নার চায়ের দোকান। সকাল থেকে সন্ধ্যা টানা চায়ের দোকানে চায়না। প্রেস ক্লাবে কোন অনুষ্ঠান থাকলে কয়েক কাপ চা অনায়েশে বিক্রি করতে পারেন চায়না। অন্যথায় কেটলির পানি গরম করেই সময় কাটাতে হয়। সেই ২০০২ সাল থেকে কেটলি আর কাপের সাথে চায়নার সম্পর্ক। তবুও দিনের উপার্জনে রাতে চুলো জ্বালানো কষ্টকর। দোকানের সামনেই প্রায়ই ঘটে মিছিল-মিটিং আর মানববন্ধন। এই সময়টাতেও চায়নাকে ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় কেটলির পাশে। অনেক সময় বিপাকেও পড়তে হয় চায়নাকে। তবে এই চায়ের দোকানের উপার্জনই বড় করেছে চায়নার মেয়ে ফাতেমাকে।


ফাতেমা বড় হয়ে চায়নার পাশে দাঁড়াবে এমন প্রত্যাশা থাকলেও হয়েছে তার উল্টো। চায়নাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে চায়নার বাবা যে ভুলটা করেছিল তেমন ভুলটাই করেছে চায়না। চায়না তার মেয়ে ফাতেমাকেও অল্প বয়সেই সন্তোষের আল-আমিনের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। দুই সন্তান হওয়ার পর ফাতেমার প্রবাসী স্বামীও খোঁজ খবর নিচ্ছে না তার। ফলে ফাতেমার সাথে দুই নাতনির দায়িত্বও পড়েছে চায়নার কাঁধে।


জীবনযুদ্ধে টিকে থাকাটা আরো কঠিন হয়েছে। চায়ের দোকানের উপার্জনে সংসার যেন চলছেই না। ফলে চায়নার মেয়ে ফাতেমা চায়ের দোকানের পাশেই সাত্তার সপিংমল নামের একটি শো-রুমে সেল্সম্যানের কাজ নিয়েছে। এখন শিশু নাতনি দুটোকে নিয়ে বিপাকে পড়েছে চায়না। প্রায়ই দেখা যায় শিশু নাতনিকে কেটলির পাশেই টেবিলে ঘুম পাড়িয়ে কাজ করছে চায়না। ফাতেমা কাজ করছে শো-রুমে। এমন চিত্র অনেকেরই বিবেকে নাড়া দেয়।


চায়না জানান, এভাবে জীবন সংগ্রামে কেটেছে তার ১৮ বছর। অনাহারে-অর্ধহারে কাটছে চায়নার জীবন। খোলা আকাশের নিচে চায়নার চায়ের দোকান জীবনের জন্য যেন এক অনিশ্চয়তা। ঝড়-বৃষ্টিতে বন্ধ রাখতে হয় তার ছোট্ট দোকানটি। চায়ের চুলো না জ্বললে বাড়ির চুলো জ্বালানোও কঠিন হয়ে পড়ে তার। চায়নার প্রয়োজন একটি স্থায়ী দোকান। যেখানে উপার্জনের একটি পথ নিশ্চিত হবে। অল্প আয়ে ক্রমশ ঋণগ্রস্থ হচ্ছে চায়না। এখন প্রায় দেড়লাখ টাকার কিস্তি টানতে হচ্ছে তাকে। এমন অবস্থায় বড়ই ক্লান্ত তিনি। জীবনের ক্লান্তির অবসান পেতে খুঁজছেন পথ। কবে তারা ভাগ্যের চাকা উল্টো দিকে ঘুরবে এমন প্রত্যাশায় চালিয়ে যাচ্ছে জীবন সংগ্রাম।


বিবার্তা/তোফাজ্জল/এনকে

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com