শিরোনাম
বিবর্তনবাদ তত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা যে মুসলিম দার্শনিক
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০১৯, ১২:০২
বিবর্তনবাদ তত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা যে মুসলিম দার্শনিক
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

আধুনিক বিজ্ঞানের যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার তার অন্যতম ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্ব। তার এই তত্ত্বে দেখানো হয়েছে প্রাণীরা সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক নিয়মে ধীরে ধীরে কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।


বিবর্তনবাদের এই তত্ত্বটি আমাদের পৃথিবীর পশুপাখি ও উদ্ভিদ জগৎ সম্পর্কে বুঝতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। তার এই প্রক্রিয়াকে ইংরেজিতে বলা হয় ন্যাচারাল সিলেকশন বা প্রাকৃতিক নির্বাচন যার মাধ্যমে একটি প্রাণীর জনগোষ্ঠী থেকে নতুন প্রজাতির উদয় ঘটে। এই থিওরি বিজ্ঞানের জগতে বৈপ্লবিক তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত।


অন দ্য অরিজিন অফ স্পেশিস নামে চার্লস ডারউইনের এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালে। তার এই গ্রন্থে তিনি বিবর্তনবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে কোনো প্রাণী ক্রমাগত অভিযোজনের ফলে আপন পরিবেশের জন্যে বিশেষায়িত হতে হতে এক সময় নতুন একটি প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়।


কিন্তু চার্লস ডারউইনের আগে ইসলামিক বিশ্বেও বিবর্তনবাদ তত্ত্বের আরো একজন প্রবক্তা ছিলেন। ডারউইনের প্রায় এক হাজার বছর আগে ইরাকে একজন মুসলিম দার্শনিক ছিলেন, যিনি প্রাকৃতিক নিয়মে প্রাণীকুলের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে তার উপর একটি বই লিখেছিলেন।


এই দার্শনিকের নাম ছিল আল-জাহিজ। যে পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন ঘটে তিনি তার নাম দিয়েছিলেন প্রাকৃতিক নির্বাচন। তার আসল নাম ছিল আবু উসমান আমর বাহার আলকানানি আল-বাসরি, তবে ইতিহাসে তিনি আল জাহিজ নামেই বেশি পরিচিত। আল-জাহিজ নামটিই বিখ্যাত হয়ে আছে তারই লেখা প্রজনন সংক্রান্ত একটি বইয়ের কারণে। গ্রন্থটির নাম কিতাব আল-হায়ওয়ান অর্থাৎ প্রাণীদের বিষয়ে বই।


তার জন্ম হয়েছিল ৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে, দক্ষিণ ইরাকের বাসরা শহরে, মুতাজিলাহ আন্দোলনের সময়। এ সময় ধর্মতাত্ত্বিক কিছু মতবাদ জনপ্রিয় হয় যেখানে মানুষের যুক্তির চর্চার উপর জোর দেয়া হচ্ছিল।


তখন ছিল আব্বাসীয় খেলাফত বা শাসনের চরম সময়। সে সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক বই গ্রিক ভাষা থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হতো। জোরালো বিতর্ক হতো ধর্ম, বিজ্ঞান এবং দর্শন বিষয়ে। এসবের কেন্দ্র ছিল বাসরা শহর। এসব আলোচনা থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল আল-জাহিজের চিন্তাধারা।


চীনা বনিকেরা ততদিনে ইরাকে কাগজের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন তত্ত্ব লিখিত আকারে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।


তরুণ আল-জাহিজ তখন নানা বিষয়ে লেখালেখি করতে শুরু করেন। যেসব বিষয়ে তার খুব বেশি আগ্রহী ছিল সেগুলোর মধ্যে ছিল বিজ্ঞান, ভূগোল, দর্শন, আরবি ব্যাকরণ ও সাহিত্য। ধারণা করা হয় তার জীবদ্দশাতেই তিনি দুশোর মতো বই প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার মাত্র এক তৃতীয়াংশ এই আধুনিককাল পর্যন্তও টিকে রয়েছে।


আল-জাহিজের বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে দ্যা বুক অব অ্যানিমেলস বা প্রাণী বিষয়ক বইটি।


এটি একটি এনসাইক্লোপিডিয়ার মতো, যাতে সাড়ে তিনশো প্রাণীর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এই বইটিতে তিনি এমন কিছু ধারণা তুলে ধরেছেন যার সাথে আধুনিক কালের বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদে তত্ত্বের চমকপ্রদ অনেক মিল পাওয়া যায়।


আল-জাহিজ তার বইতে লিখেছেন, টিকে থাকার জন্যে প্রাণীদেরকে লড়াই করতে হয়। লড়াই করতে হয় তাদের খাদ্যের জন্যেও এবং তারা নিজেরাই যাতে অপরের খাদ্য না হয়ে যায় সেটা নিশ্চিত করার জন্যে। এমনকি প্রজননের জন্যেও তাদেরকে সংগ্রাম করতে হয়।


তিনি লিখেছেন, নিজেদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে গিয়ে পরিবেশের নানা কারণে প্রাণীরা নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং এভাবেই তারা নতুন নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়।


তিনি আরো লিখেছেন, যেসব প্রাণী প্রজনন ঘটাতে টিকে থাকতে পারে তারা তাদের সফল বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারে।


আল-জাহিজের কাছে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল যে, এসব প্রাণীকুলকে টিকে থাকার জন্যে অনবরত সংগ্রাম করতে হয় এবং একটি প্রজাতি সবসময়ই আরেকটি প্রজাতির চেয়ে শক্তিশালী। টিকে থাকার জন্যে খাবার সংগ্রহের লড়াই-এ প্রাণীদের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়। অন্যের খাবার হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং সন্তান জন্মদান করতেও তাদের সংগ্রাম করতে হয়। এসব কারণে তারা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে রূপান্তর ঘটাতে বাধ্য হয়।


আল-জাহিজের এসব ধারণা তার পরবর্তী অন্য মুসলিম চিন্তাবিদদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন আল-ফারাবি, আল-আরাবি, আল বিরুনী এবং ইবনে খালদুন।


পাকিস্তানের 'আধ্যাত্মিক পিতা' মোহাম্মদ ইকবাল, যিনি আল্লামা ইকবাল নামেই অনেক বেশি পরিচিত তিনিও আল জাহিজের এসব তত্ত্বের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত তার বক্তব্যের একটি সঙ্কলনে তিনি বলেছিলেন, আল-জাহিজ দেখিয়ে দিয়েছেন অভিবাসন এবং পরিবেশে পরিবর্তনের কারণে প্রাণীদের জীবনে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে।


বিবর্তনবাদের ধারণায় মুসলিম বিশ্বের অবদান বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় পণ্ডিতদের কাছে গোপনীয় কোনো বিষয় নয়। এমনকি ডারউইনের একজন সমসাময়িক বিজ্ঞানী উইলিয়াম ড্রেপার ১৮৭৮ সালে "বিবর্তনবাদের মোহাম্মদীয় তত্ত্ব" নিয়ে কথা বলেছিলেন।


তবে ডারউইন মুসলিম বিজ্ঞানী আল-জাহিজের চিন্তাধারা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন কিনা কিম্বা তিনি আরবি বুঝতেন কিনা তার পক্ষে কোনো তথ্য প্রমাণ নেই।


ব্রিটিশ এই বিজ্ঞানী প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে বিবর্তনবাদের তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন যেখানে প্রাণীর টিকে থাকার সংগ্রামের কথা বিশদ ও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।


জ্ঞানের অন্বেষণ করতে গিয়েই মুসলিম দার্শনিক আল-জাহিজের মৃত্যু হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, ৯২ বছর বয়সী আল-জাহিজ একটি আলমারি থেকে বই নামাতে গিয়ে আলমারিটি তার গায়ের ওপরে পড়ে গেলে তিনি মারা যান। সূত্র: বিবিসি বাংলা


বিবার্তা/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com