অসচেতনতা ও কুসংস্কারের শিকড় সমাজের যে কতটা গভীরে পৌঁছেছে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ধরা পড়ল ভারতের কর্নাটক রাজ্যের একটি গ্রামে।
রাজ্যেরই ধারওয়ার জেলার ছোট্ট গ্রাম মোরাব। এই গ্রামেই রয়েছে ৩৬ একরের একটি বিশাল হ্রদ। আকারে প্রায় ২৫টা ফুটবল মাঠের সমান এটি। হ্রদটি নাবালগুন্ড তালুকের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এটি মোরাব গ্রামের ‘লাইফলাইন’। কারণ পুরো গ্রাম এই হ্রদের পানি পান করেন।
সপ্তাহখানেক আগে এই হ্রদেই ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন গ্রামেরই এক মহিলা। গত ২৯ নভেম্বর মহিলার দেহ হ্রদের পানিতে ভাসতে দেখেন কয়েকজন গ্রামবাসী। আর দাবানলের মতো খবরটা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। কারণ গোটা গ্রাম জানত ওই নারী এইডসে আক্রান্ত। ফলে তার দেহ যখন হ্রদের পানিতে ভাসতে দেখেন গ্রামবাসী, তখন তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
গ্রামবাসীদের মনে আতঙ্কের কারণ হলো তাদের ধারণা, ওই নারীর শরীরে থাকা এইডসের জীবাণু হ্রদের পানিতে মিশে গেছে। ফলে সেই পানি দূষিত হয়েছে। তাই কোনোভাবেই ওই পানি আর পানের যোগ্য নয় বলেই মনে করছেন তারা।
হ্রদের সব পানি বের করে ফেলতে হবে বলে তারা উপায় বের করেন। তারা বলেন, তারা এই পানি আর খাবেন না। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে এ বিষয়ে সুপারিশও করেন গ্রামবাসী।
প্রশাসনের কানে খবরটা পৌঁছতেই কর্মকর্তাদের মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে। বলেন কি গ্রামবাসী! এত বড় একটা হ্রদের পানি সরাবেন কী ভাবে? প্রশাসনিক কর্মকর্তারা গ্রামবাসীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন এইচআইভি আক্রান্ত ওই নারী হ্রদে আত্মহত্যা করেছেন ঠিকই, কিন্তু তার শরীরের জীবাণু কোনোভাবেই পানিতে মেশেনি। আর এইচআইভির সংক্রমণও এভাবে হয় না। পানি পরীক্ষা করারও আশ্বাস দেয় প্রশাসন।
কিন্তু গ্রামবাসী প্রশাসনের কথা শোনেননি। এক গ্রামবাসীর কথায়, এইচআইভি আক্রান্ত ওই নারীর বদলে অন্য কোনো ব্যক্তি যদি ওই হ্রদে ডুবে মরতেন, তা হলে আমাদের এত আপত্তি থাকত না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনোভাবেই ওই পানি খাওয়া সম্ভব নয়। গ্রামবাসীদের জীবন বাঁচাতে হ্রদের পানি পাল্টে ফেলাটাই শ্রেয়।
আরেক গ্রামবাসী প্রদীপ হানিকেরে আবার প্রশ্ন তুলেছেন, নিজেদের পানির বোতলে কোনো নোংরা থাকলে সেই পানি কি খান কর্মকর্তারা? তাহলে আমাদের ওই হ্রদের পানি খেতে বলছেন কী ভাবে?
অগত্যা গ্রামবাসীদের জেদের কাছে নতস্বীকার করতেই হয়েছে প্রশাসনকে। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই পাম্প লাগিয়ে ওই পানি বের করে দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে।
গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য লক্ষ্মণ পাতিল বলেন, গত পাঁচ দিন ধরে দিন-রাত এক করে ৫০ জন লোক দিয়ে পানি বের করার কাজ চালানো হচ্ছে। এখনও ৬০ শতাংশ পানি বের করা বাকি। এদিকে তালুক প্রশাসন ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো বিষয়টি শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে। না করলে গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে মালাপ্রভা খাল বন্ধ করে দেয়া হবে বলেও জানিয়েছে তারা।
এদিকে গ্রামের বাইরে ২-৩ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে মালাপ্রভা খাল থেকে পানি এনে খাচ্ছেন গ্রামবাসী। এতে অসুবিধা হচ্ছে না? এ প্রসঙ্গে এক গ্রামবাসী জানান, এইচআইভি জীবাণুযুক্ত পানি খেয়ে মরার চেয়ে, কষ্ট করে পানি এনে খাওয়া ঢের ভাল!
এইচআইভি পজিটিভ আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা আশা ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর চিকিত্সক গ্লোরি আলেকজান্ডার বলেছে, সমাজে এইচআইভিকে যতটা না কলঙ্ক হিসেবে দেখা হয় তার চেয়ে এটা একটা আতঙ্ক হিসেবেই সমাজে চারিয়ে গেছে বেশি। আর এর জন্য শুধুমাত্র অসচেতনতাকেই দায়ী করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, যখন কোনো এইচআইভি পজিটিভ ব্যক্তি মারা যান, তার সঙ্গে সঙ্গে সেই জীবাণুরও মৃত্যু হয়। সেই জীবাণু দেহের বাইরে কোনোভাবে এলেও পানির সংস্পর্শে কোনোভাবেই বাঁচে না। তাই পানিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
বিবার্তা/জাকিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]