ডিম ছাড়ার মৌসুম এলে সমুদ্র থেকে ঝাঁক বেঁধে ইলিশ মিঠা পানির নদীতে প্রবেশ করে। ডিম ছাড়া শেষ হলে তারা কোথায় যায়? এতদিন সবাই জানতো, সাগরের ইলিশ সাগরেই ফিরে যায়। কিন্তু হালে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, না।
ভারতের কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে মিঠা পানির নদীতে ঢুকে বহু ইলিশই আর কখনও সাগরে ফিরে যাচ্ছে না।
ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ঠিক এ কারণেই এখন গঙ্গার মোহনা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার উজানেও সারা বছর ধরে ইলিশ মিলছে এবং স্বাদে-গন্ধেও সেগুলো দারুণ!
কিন্তু কেন সাগরে ফিরে যাচ্ছে না কিছু ইলিশ? বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, সাগরের মোহনায় পাতা মাছধরা জালের ভয়েই ইলিশের ঝাঁক মিষ্টি পানিতে রয়ে যাচ্ছে।
ওই গবেষক দলের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী, অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ বলেন, ইলিশের 'অটোলিথে' বিভিন্ন রাসায়নিকের পরিমাণে তারতম্য দেখে তারা এর প্রমাণ পেয়েছেন।
তিনি বলেন, "অটোলিথ মাছের একটা অর্গ্যান, যা ইলিশের মাথায় থাকে। এই অটোলিথ বিশ্লেষণ করে একটা মাছের মাইগ্রেটরি রুট সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। আমরা ইলিশের অটোলিথ কেটে দেখতে পাচ্ছি সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিকের অনুপাত এমন, যা থেকে স্পষ্ট যে অনেক ইলিশই আর সাগরে ফিরছে না। মিঠা পানিতে এগুলোর বেশ ওজনও হয়ে গেছে - পাঁচশো বা সাড়ে পাঁচশো গ্রাম - আবার ওদিকে ক্ষুদে সাইজের পাঁচ-দশ গ্রাম ওজনের ইলিশও মিলছে।"
আসলে সাগরে না-ফেরাটা এই ইলিশগুলোর এক ধরনের বেঁচে থাকার চেষ্টা বা 'ন্যাচারাল সিলেকশন' বলেই মনে করছেন ভারতের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফিশারিজ এডুকেশনের মুখ্য বিজ্ঞানী বি. কে. মহাপাত্র। তিনি বলেন, "ইলিশ হলো অ্যানাড্রোমাস মাছ, তারা সাগর থেকে ডিম পাড়তে যায় নদীর ভেতর। কিন্তু কেন এখন তারা আর ফিরতে চাইছে না? চাইছে না, কারণ গঙ্গার এসচুয়ারিজুড়ে বিছানো আছে ১৪ হাজারেরও বেশি জাল। তাই প্রাণে বাঁচতেই তারা রয়ে যাচ্ছে মিষ্টি জলে। এটাকে বিবর্তনবাদ বা ন্যাচারাল সিলেকশন হিসেবেই দেখা যায়''।
অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ বলেন, বহু বছর আগে গুজরাটে দেখা গিয়েছিল, তাপ্তী নদী বেয়ে ইলিশের ঝাঁক উকাই জলাধারে ঢুকে সেখানেই থাকতে শুরু করে, ডিম পাড়ে ও তাদের বাচ্চাও হয়। এখন অনেকটা একই ধাঁচের জিনিস দেখা যাচ্ছে গঙ্গাতেও। গঙ্গায় কাকদ্বীপের নিচে নিশ্চিন্দাপুরে যেখানে মিঠা পানি শুরু, সেখান থেকে ওপরে আপনি যদি ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি ওপরে বলাগড় অবধি যান, সেখানে ক্যালেন্ডার করে আমরা দেখতে পাচ্ছি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ-প্রাক মনসুন-মনসুন কিংবা পোস্ট-মনসুন ... সারা বছরই কিন্তু এই পুরো এলাকা জুড়ে ইলিশ মিলছে।
তবে অধ্যাপক নাথ সেই সঙ্গে বলছিলেন, বিশেষত বর্ষার পর কৃষিক্ষেতের কীটনাশকযুক্ত জল যখন এসে নদীগুলোতে মেশে, তখন এই মিঠা পানির ইলিশগুলোর বিরাট ক্ষতিও হয়ে যায়। এই ইলিশদের বেশি দূষণের শিকার হতে হচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পরেও স্বাদে-গন্ধে সেগুলো কিন্তু অন্য ইলিশের চেয়েও ভালো।
তার কথায়, "মিঠা পানিতেই কিন্তু ইলিশের স্বাদ বাড়ে। কারণ নদীতে ঢোকার পরই তাদের শরীরে ফ্যাট বাড়ে, সেগুলো খেতেও অনেক ভালো হয়। গভীর সমুদ্রে ধরা ইলিশের স্বাদ কখনওই তেমন হয় না। ফলে এগুলোর স্বাদ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই!"
ইলিশ কখনও সাগরে না সাঁতরালে তাকে আদৌ সত্যিকারের ইলিশ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য মৎস্যবিজ্ঞানী ও খাদ্যরসিকদের মধ্যে দু'রকম মত আছে। কিন্তু ভারতীয় বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, বেশ কিছু ইলিশ আর কখনওই সাগরে ফেরার টান অনুভব করছে না আর জেলেরা গঙ্গায় সেই ইলিশই পাচ্ছেন বছরজুড়ে! সূত্র : বিবিসি
বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]