শিরোনাম
ব্রিটেনের এমপি-মন্ত্রী : কাছে থেকে দেখা
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০১৮, ১৬:০৮
ব্রিটেনের এমপি-মন্ত্রী : কাছে থেকে দেখা
দেবাশীষ দাস
প্রিন্ট অ-অ+

আমি আর আমার পরিবার ইংল্যান্ডে মাইগ্রেট করার পর প্রথম দিকটায় পূর্ব লন্ডনে থাকতাম। আমরা যে রোডে থাকতাম সে রোডেই, আমাদের বাড়ি থেকে কয়েকটি বাড়ি পর এক সৌম্যদর্শন, লম্বা, মধ্যবয়সী ইংরেজ থাকতেন। আমি তখন সেন্ট্রাল লন্ডনে একটি গ্রুপে কাজ করি। প্রতিদিন সকালেই ইংরেজ ভদ্রলোক আর আমি একই সময়ে বাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে যেতাম। ভদ্রলোকের সাথে আমার হাই-হ্যালো হতো ঠিকই, কিন্তু কখনো আলাপ করা হয়ে ওঠেনি।


ইংল্যান্ডে সেবার সাধারণ নির্বাচন আসন্ন । এক শনিবার সকালে ডোরবেল বাজার শব্দ পেয়ে দরজা খুলতেই দেখি, আমার সকালের সহযাত্রী-প্রতিবেশী সেই ইংরেজ ভদ্রলোক আর সাথে জনাকয়েক লোক দাঁড়িয়ে। ভদ্রলোককে ভেতরে আসতে বলাতে বিনয়ের সাথে বললেন যে তিনি ভেতরে আসবেন না, বরং বাইরে থেকেই কিছু কথা বলতে চান।


নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে ভদ্রলোক বললেন যে উনি বৃটিশ পার্লামেন্টের একজন সদস্য (এমপি) এবং অর্থনীতি সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি। আসন্ন নির্বাচনে উনি আমার সমর্থন চাইছেন।


আমি হতবাক! ওনাকে ভেতরে এসে চা পানের কথা বলতেই উনি বললেন, কোনো ভোটারের বাসায় চা পান বা ভোটারের আমন্ত্রণে কো্নো রেস্তোরায় লাঞ্চ-ডিনারের আমন্ত্রণ নেয়া ব্রিটেনের নির্বাচন আচরণবিধিবহির্ভূত। একইভাবে ভোটপ্রার্থীও কোনো ভোটারকে আপ্যায়িত করতে পারবেন না। সবচাইতে অবাক হলাম এটা জেনে যে, নির্বাচনে প্রার্থীরা নিজ খরচে বা ভোটারদের চাঁদায় কোনো আউটডোর নির্বাচনী সভা, নির্বাচনী ভোজ, পাবলিক প্লেসে মাইকিং, পোস্টারিং - কিছুই করতে পারবেন না। পূর্বঅনুমতিসাপেক্ষে কেবল ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ক্যাম্পেইন করতে পারবেন। আরো অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর যে কোনো নাগরিক, ব্রিটেনের নাগরিক হোন বা না হোন, ব্রিটেনে সাময়িক বা স্থায়ী আবাসিক স্ট্যাটাস থাকলেই সেদেশের সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন। আর এ ধরনের নতুন ভোটারদের সমর্থন পাওয়াটাই প্রার্থীদের টার্গেট থাকে।


ভদ্রলোক নির্বাচনে জিতলেন। যথারীতি আবার মন্ত্রী পদমর্যাদায় ক্যাবিনেটে সংসদীয় কমিটির সভাপতি হলেন। প্রতি সকালে আমরা আবার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনের সহযাত্রী হলাম। জানতে পারলাম, প্রতি সকালে উনি সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতেই ট্রেনে চেপে পার্লামেন্ট ভবনে যান।


এমপি সাহেবের বাড়ির ড্রাইভওয়েতে আমি সবসময়ই দুটো গাড়ি পার্ক করা থাকতে দেখি। কৌতূহল মেটাতে একদিন ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাড়ির সামনে সবসময়ই দুটো গাড়ি পার্ক করা থাকে, তারপরও তুমি পাবলিক ট্রেনে চেপে অধিবেশনে যাও কেন? আবার সেই বিনয়ের সাথেই তিনি বললেন, বৃটিশ এমপি বা মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে? আমি না-সূচক উত্তর দিতেই উনি বললেন, আমি গাড়ি নিয়ে অধিবেশনে গেলে আমার বেতনের অর্ধেকের বেশি টাকাই সেন্ট্রাল লন্ডনের কনজেশন চার্জ, পার্কিং খরচ আর প্রতিদিনের খাওয়া খরচে বেরিয়ে যাবে। এত খরচ করার মতো বেতন-ভাতা তো আমরা পাই না!


এবার আমি সত্যিই লজ্জা পেলাম। সাথে সাথেই বাংলাদেশের এমপি-মন্ত্রীদের জীবনযাত্রা চোখে ভেসে উঠলো। বাংলাদেশে আমার সহপাঠী বা ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যেই বেশ কয়েকজন এমপি-মন্ত্রী আছেন, ওনাদের জীবনযাত্রার সাথে তুলনা করা তো দূরের কথা, ওনাদের এপিএস-দের জীবনযাত্রার ধারেকাছেও বৃটিশ এমপি-মন্ত্রীরা যেতে পারবেন না।


পরে বৃটিশ পার্লামেন্টে অনেকবার গেছি। একবার আমরা ক'জন এক ডাকসাইটে বৃটিশ এমপি-র আমন্ত্রণে পার্লামেন্ট ভবনে ওনার সাথে নির্ধারিত এক মিটিঙে যোগ দিতে যাই। উনি আবার সারা পৃথিবীর সংখ্যালঘুদের স্বার্থসংরক্ষণ আর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিচালনা সংক্রান্ত বৃটিশ সংসদীয় কমিটির সভাপতি। আমি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ছিলাম। পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরেই এক ক্যাফেটেরিয়ে আছে। মিটিং শুরু হওয়ার আগে কিছু খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করতেই এমপি সাহেব নিজে উঠে লাইনে দাঁড়িয়ে ক্যাফেটেরিয়ে থেকে খাবার আর চা এনে আমাকে সার্ভ করলেন। সেদিন আমি বুঝলাম, কেন এদের সভ্য বলা হয়।


বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সূচকে দ্রুত উপরে উঠছে। ঢাকার দিগন্ত বদলে যাচ্ছে চোখধাঁধানো বিশাল অট্টালিকার ভিড়ে। ফ্লাইওভার , মেট্রো রেল , এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে আগামী পাঁচ বছরে ঢাকাকে এক তিলোত্তমা নগরীতে উন্নীত করবে । কিন্তু আমাদের বোধ, চিন্তাভাবনা বা মানসিকতার যদি পরিবর্তন না হয়, আমরা যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে যাবো।


বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com