শিরোনাম
রেশম সড়কে রহস্যময় ভ্রমণ
প্রকাশ : ০৬ মে ২০১৮, ১৫:৩৪
রেশম সড়কে রহস্যময় ভ্রমণ
মূল : পল স্যালোপেক রূপান্তর : হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
প্রিন্ট অ-অ+

আমি পায়ে হেঁটে পৃথিবী পরিভ্রমণ করছি। আবিষ্কার করছি প্রস্তরযুগের মানুষদের চলে যাওয়া সেই পথ, যা এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ পথ খুঁজে বের করার জন্য তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি রীতিমতো সংগ্রাম করে চলেছি।


আমার পথচলা শুরু হয়েছে ইথিওপিয়া থেকে; উটের পিঠে চড়ে। চলেছি অসংখ্য জলাশয় ও নোনা কাদাভর্তি পথ মাড়িয়ে। আরবের হেজাজ মরুভূমির একের পর এক মরূদ্যান পাড়ি দিয়েছি। শীতে ককেসাসের শৃঙ্গে পিপাসায় যখন ছাতি ফেটে যাচ্ছে, তখন আমার চার পাশে টনকে টন পানি। কিন্তু ওই পানি মুখে দেয়ার উপায় নেই। সব জমে বরফ হয়ে আছে। সেই বরফও পাথরের মতো শক্ত।


এরই মধ্যে ঘটল এক ঘটনা, যেমনটি আমার জীবনে আর কখনো ঘটেনি। কে বা কারা আমার পানির পাত্রটি চুরি করে নিয়ে গেল। ওখানে সামান্য পানি ছিল - ১৫ লিটারের মতো। হায়, কী হবে এখন! শূন্য পানির পাত্রটি মৃদু হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে। সে দিকে তাকিয়ে আমি নিজের চোখের পানিই ঠেকাতে পারলাম না।


জানলাম, এই কিজিলকামে জ্বিনেরাই পথিকের পানি চুরি করে নিয়ে যায়। আমার পানিও ওরাই চুরি করেছে। কিন্তু বুঝলাম না, জ্বিন কী?


যাযাবরদের মতে, জ্বিন হলো অৃদশ্য আত্মা। ওরা মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে বাস করে আর কখনো পর্যটকদের ক্ষতি করে, কখনো সাহায্য। এবার বুঝলাম। এখানে যাকে জ্বিন বলা হচ্ছে, পাশ্চাত্যে তাদের ‘জিনি’ বলা হয়। কার্টুন ছবিতে তাদের বেশ দেখা যায়। ইয়া বড় পাগড়ি মাথায়, থাকে প্রদীপে অথবা বোতলে। আর এখানকার পশুপালকদের মতে, জ্বিনদের অনেক ক্ষমতা। ওরা চাইলে এক রাতেই হাজার-হাজার মাইল পথ পাড়ি দিতে পারে। ধরতে পারে সাপ অথবা নেকড়ের রূপ। প্রাচীনকালের বিশ্ব পর্যটক মার্কো পোলোর ভ্রমণবৃত্তান্তে জ্বিনদের কাণ্ডকারখানার বর্ণনা আছে। তিনি যখন পশ্চিম চীনের লপ মরুভূমি পাড়ি দিচ্ছিলেন তখন তাদের ক্যারাভান এক দুষ্ট জ্বীনের কবলে পড়ে। এ সময় তার ভ্রমণসঙ্গীদের কেউ কেউ হঠাৎ পথ হারিয়ে ফেলত, আর কিছুতেই ক্যারাভানে ফিরতে পারত না। এভাবে তারা বেশ-ক’জন সাথীকে হারিয়ে ফেলেন।
এসব ঘটনা ঘটত কিজিলকামে। জায়গাটি কোথায়, তা-ই বলছি।


কাজাখস্তান সীমান্ত ছাড়িয়ে দক্ষিণ উজবেকিস্তানের দিকে সোজা হাঁটা দিলে পথে পড়বে একটি ভয়ঙ্কর মরুভূমি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার সমান আয়তনের এই মরুভূমি পাড়ি দিয়েই হাজার বছর ধরে সিল্ক রুটের পথে চলছে ক্যারাভান। ২,২০০ বছর ধরে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় বাণিজ্যপথ। এখন এ পথে আলো বসেছে। কিন্তু তার পরেও ছোট ছোট অসংখ্য কাঁটাঝোপ পথের বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকেও কম বাধা দেয়নি।


এ-ই হলো কিজিলকাম। কিন্তু পানি চুরি করল কে? আমার গাইড আজিজ খালমুরাদভ একজন গর্বিত উজবেক। সে সাফ বলে দিলো, ‘চোবানদের দোষ দিয়ো না কিন্তু!’ চোবান মানে স্থানীয় পশুচারণকারী বা রাখাল। আজিজের কথা, ‘এখানে পানি চুরি বিরাট অপরাধ। এ কাজ করার সাহস কেউ দেখাবে না।’


তা রাখালরা যদি চুরি না-ই করে, তবে পানিগুলো গেল কোথায়, চুরি করল কে?


আজিজ ও আমি অবিরাম হেঁটে চলেছি সূর্যের তাপে জ্বলন্ত কয়লার মতো গনগনে হয়ে ওঠা বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে। আমাদের সাথে আছে স্যাটেলাইট ফোন। ওটির সাহায্যে যোগাযোগ রাখছি বাক্সোরো নামে এক প্রাচীন মরূদ্যান নগরীর সাথে; যে শহরটি হাঁটাপথে দুই দিনের দূরত্বে অবস্থিত।


বেশ কিছু পথ পেরিয়ে এক জায়গায় আমরা বসে পড়লাম। দেখতে থাকলাম জ্বলন্ত দিগন্তরেখা। আমাদের মনের চোখে ভেসে উঠল অষ্টম শতাব্দীর চিত্র। আমরা এখন যেখানে বসে আছি তার উত্তর-পূর্ব দিকে চীনের তারপান শহর। ওই সময় একজন ব্যবসায়ী ৪০ বান্ডিল কাঁচা রেশমের বিনিময়ে ১১ বছর বয়সী কোনো বালিকাকে দাসী হিসেবে কিনে নিতে পারতেন। আর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, আজ থেকে হাজার বছর আগে অভিযানে এসেছিলেন আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট। বিশাল ঝুঁকিপূর্ণ সে অভিযান। আর আজ? ইউরোপ ও এশিয়াজুড়ে একটি আধুনিক রেশম সড়ক নির্মাণ করার জন্য ট্রিলিয়ন ডলার ঢালছে চীন। এক ঢোক পানির জন্য আমি ভাবছি? ক’ পয়সা লাগে এতে?


তামাটে আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মধ্যরাতের পর হঠাৎ গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে আলোর ফুটকি দেখতে পেলাম। এটা আমাদের চার দিকে ঘুরতে থাকল - প্রথমে কাছ দিয়ে, তারপর দূরে সরে গেল। তারপর আবার কাছে এলো। মহা বিরক্তিকর ব্যাপার। আজিজ ফিসফিস করে বলল, ‘আমাদের উদ্ধারকারী গাড়িটি হারিয়ে গেছে।’ বলেই সে আলোর ফুটকির দিকে তাক করে পাগলের মতো হেডল্যাম্পটি দোলাতে লাগল। কিন্তু আসল ব্যাপার কী, তা তো আমি ভালোই জানি। ওই আলোটা হচ্ছে জ্বিন।
মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে এই জ্বিনদের দেখা মেলে সেই অনাদিকাল থেকে। ইসলামী বিশ্বাসমতে, ফেরেশতারা নূরের তৈরি, মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে আর জ্বিন ধোঁয়াবিহীন আগুন দিয়ে সৃষ্ট। জ্বিনদের নিজেদের রাজা আছে, শহর আছে, ক্যারাভান আছে। তারা যতক্ষণ ইচ্ছা অদৃশ্য হয়ে থাকতে পারে। তারা লোহা পছন্দ করে না। তারা কোনো খালি বাড়ি পেলে সেটা দখল করে (তবে সেখানে ঘুমায় না)। জ্বিনদের মধ্যে অল্পসংখ্যক মুসলমান আছে, যারা শান্তিপ্রিয়। আর অন্য জ্বিনেরা সবসময় মানুষের ক্ষতি করতে চায়। আপনি যদি মরুভূমির পশুপালকদের মধ্যে জ্বিন লুকিয়ে আছে কি না জানতে চান, তবে নিচের দিকে চোখ রাখুন। যার পা দেখবেন উল্টো দিকে, সে-ই জ্বিন।


যাক এসব কথা। আমি মধ্য এশিয়া পরিভ্রমণ শুরু করেছি কাজাখস্তানের কাস্পিয়ান সাগরের আকতুয়া বন্দর থেকে। গাইড হিসেবে আমার সাথে আছেন দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাদের একজন দৌলত বেগেনদিকভ। তিনি কাজাখস্তানের একজন সাবেক বিচারপতি। তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিজের পিস্তল থেকে একবার ফাঁকা গুলি ছোড়েন। উদ্দেশ্য : মরুভূমির নেকড়ে (এবং জ্বিনও) তাড়ানো। অপরজন তারগাত ওমারভ। তিনি একটি হালাল গোশতের দোকানের মালিক। খুবই ধার্মিক মানুষ। ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে ছবি পর্যন্ত তুলতে দিতে রাজি হন না। আমাকে ক্যামেরা হাতে নিতে দেখলেই জিনিসপত্রের আড়ালে লুকিয়ে যান।


মে মাস এলেই কাজাখস্তানের বৃক্ষহীন প্রান্তর সবুজ হতে থাকে। পিঙ্গল আকাশের তলায় হঠাৎ জেগে ওঠে ক্লোরোফিলের সাড়া। প্রায় পাঁচ লাখ বর্গমাইল প্রান্তরজুড়ে জেগে ওঠা ফ্যাকাশে সবুজ ঘাসের মাঝখান দিয়ে আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকি। সবুজ ঘাস খেতে পেয়ে আমাদের পশুগুলোও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অচল জেনেও আমরা মোবাইল ফোনগুলো বার বার টিপতে থাকি; যদি দৈবাৎ প্রিয়জনের বার্তা পেয়ে যাই! আর যাত্রার প্রথম দিন থেকেই আমরা রেশম সড়কের নতুন ‘রেশমের’ দেখা পেতে থাকি, যার নাম হাইড্রোকার্বন।


কাজাখস্তান হলো বিশ্বের ১৫তম অপরিশোধিত তেল উৎপাদনকারী দেশ এবং সেই সাথে প্রাকৃতিক গ্যাসেরও বড় সরবরাহকারী। এ জন্য দেশটি তার পশ্চিমাঞ্চলীয় তৃণভূমিতে নির্মাণ করেছে কয়েক হাজার মাইল লম্বা পাইপলাইন। ইস্পাতের তৈরি এসব পাইপ অতিক্রম করা যাবে না। তাই আমাদের ক্যারাভানকে একটি বাইনারি চয়েস দেয়া হলো - হয় ডানে যাও, নয়তো বামে। এভাবে গেলে আমরা পথে অনেক প্রয়োজন মেটানোর উপকরণ সহজে পেতে পারি।


যা হোক, কারাকুদুকের তেলসম্পদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা করলেই আমরা মধ্য এশিয়ার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের একটি মিনিয়েচার চিত্র পেয়ে যেতে পারি।


মধ্য এশিয়ায় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার ও উন্নয়ন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর; আমেরিকান প্রতিষ্ঠান চ্যাপারাল রিসোর্সেসের হাতে। কিন্তু তখনো এর বিশাল সম্ভাবনাটি যথাযথভাবে উপলব্ধ হয়নি। আজকের যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স, তখন তা দিগন্তপ্রসারী ঘাসবনের নিচে ঘুমন্ত। এ অবস্থায় রাশান অয়েল জায়ান্ট লুক অয়েল এটির দায়িত্ব নেয়। কিন্তু তারাও এর সুপ্ত সম্ভাবনাটি বুঝতে বা কাজে লাগাতে পারেনি। ফলে তা চলে যায় চীনা কম্পানি সিনোপেকের হাতে।
চীন যখন এই সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনার দায়িত্ব নেয়, আমেরিকা তখন আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠাতে ব্যস্ত। আর রাশিয়া ভেবে মরছে কী করে ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কাউন্সিলের সাহায্যে ওই অঞ্চলের ওপর তার হারানো কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করা যায়। এই সময়টাতে কেবল চীন, যারা কিনা রেশম সড়কের মূল চালিকাশক্তি, তারা মধ্য এশিয়ার চূড়ান্ত ‘পাওয়ার ব্রোকার’ হিসেবে আবির্ভূত হতে থাকল। তেলক্ষেত্রে বিনিয়োগের বাইরেও চীন বিশ্বের বৃহত্তম যে অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করে চলেছে সেটি হলো দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। এর অধীনে নির্মিত হবে সমুদ্রবন্দর, রেলপথ, সুপারহাইওয়ে ও টেলিযোগাযোগব্যবস্থা, যা ৬০টি দেশের ভোক্তাবাজারকে একীভূত করবে। এ হিসেবে বলা যায়, নতুন রেশম সড়কটি হবে চৈনিক।


হঠাৎ বিপদ


তেলখনির কন্ট্রোল রুমে আমাদের দেখতে পেয়ে কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না সিনোপেক-এর চৈনিক বস মি লিউ। শেষে বললেন, ‘তোমরা এখানে ঢুকলে কী করে?’ আমাদের জবাব শোনার আগেই হতভম্ব লিউ জানতে চাইলেন, ‘তোমরা কি চা-টা কিছু খাবে?’


চায়ের কথা বললেন বটে, তবে চা নিয়ে কোনো তাড়াও দেখা গেল না তার মধ্যে। অবশ্য আমরা ত্রিমূর্তি যে তাদের ক্যান্টিনে অনধিকার প্রবেশ করে বুভুক্ষুর মতো গোগ্রাসে গিলেছি চিকেন লোফ, ম্যাসড পটেটো, প্লাম জুস ও অ্যাপল কেক, তা নিয়েও মাথা ঘামাচ্ছেন না তিনি। মি. লিউর দুর্ভাবনা হচ্ছে নিরাপত্তা নিয়ে। অয়েলফিল্ডের ১০ মাইল বিস্তৃত নিরাপত্তাবলয় ভেঙে আমরা তিন ব্যক্তি কী করে এখানে ঢুকে পড়লাম, কেন কোনো একটি মোশন সেন্সরেও একটি রিং বেজে উঠল না - কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না মি. লিউ।


যা হোক, কম্পানির একজন গার্ড যথেষ্ট বিনয়ের সাথে পাহারা দিয়ে আমাদেরকে তাদের সীমানার বাইরে পৌঁছে দিলো। আমরা চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত সে তার গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়েই থাকল। এদিকে তেলক্ষেত্রের যারা স্থানীয় কর্মী, তারা নিশ্চিত হয়ে গেল যে আমরা হচ্ছি জ্বিন। নইলে নিরাপত্তাব্যবস্থাকে কেউ ফাঁকি দিতে পারে?


কাজাখ গাঁয়ের পথে


সূর্যটাকে দেখাচ্ছে আকাশের গায়ে একটা সাদা ছিদ্রের মতো। মেঘ নেই। হাওয়া নেই। পুরো প্রান্তর প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করছে।


আমরা চলেছি প্রত্যন্ত এক কাজাখ গ্রামের পথে। সেই গ্রামের আদিয়ানা মরিয়মবায়েভা নামের এক সৃজনশীল নারী চীনা ওয়াশিং মেশিনের সাহায্যে কুমিজ (একধরনের পানীয়) তৈরির নতুন পদ্ধতি বের করেছেন।


সীমান্তের চেকপয়েন্টে এক অস্ত্রধারী থামাল আমাদের। সে আমার ভিসার দিকে তাকালই না। আমাদের ব্যাগও চেক করল না। কিন্তু ক্রুদ্ধ স্বরে জানতে চাইল, ‘তোমাদের সাথে কি ধর্মীয় বইপত্র আছে? কোরআন আছে?’


এখানে বলে রাখি, উজবেকিস্তানের পুলিশ হচ্ছে মধ্য এশিয়ার জিহাদবিরোধী দুর্গবিশেষ। এরা কারো গালে দাড়ি দেখলেই তার পেছনে লাগে। আর মসজিদে মসজিদে ওদের গুপ্তচর লাগানো আছে। এদের ধর্মভীতি কুখ্যাত। তবে এদের প্রতিবেশীরা আবার অন্য রকম। আফগানিস্তান তো এদের পাশেই। উজবেক যুবকেরা সে দেশে ছুটে যাচ্ছে তালেবানের পাশে থেকে যুদ্ধ করার জন্য। যাচ্ছে সুদূর সিরিয়ায়ও; আইএসের হয়ে লড়াই করতে। এমনকি অপেক্ষাকৃত শান্ত দেশ কাজাখস্তানের রাস্তায় হাঁটার সময় আমি গুঞ্জন শুনেছি যে, দুষ্ট জ্বিনেরা মানুষের বিষয়ে প্রভাব খাটাচ্ছে : ইসলামি জঙ্গিরা ‘বেহেশতি বিপ্লবের’ জন্য অস্ত্র জোগাড় করতে ন্যাশনাল গার্ডের একটি ঘাঁটি এবং বেশ কিছু বন্দুকের দোকানে হামলা চালিয়েছে।


ইসলামের নামে উগ্রবাদের প্যারাডক্সটা হলো এই যে, যে-ঐতিহাসিক খিলাফতব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলে এই উগ্রবাদীর দল লড়ছে, সেই খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে তা-ই একদিন ওদেরকে ছুড়ে ফেলে দেবে। মধ্যযুগে যখন মুসলিম বিশ্ব শৌর্যবীর্যের শীর্ষে, তখন তাদের এই উত্থানের মূল কারণ ছিল তারা মৌলবাদী ছিল না, বরং ছিল সহিষ্ণু, খোলামেলা ও সন্ধানী। রেশম পথ সৃষ্টির পেছনেও এই চেতনাই কাজ করেছে। উজবেকিস্তানের খোরেজম মামুন অ্যাকাডেমি মিউজিয়ামের ইতিহাসবিদ শাখজুখামিলজু ইসমাইলভ এ বিষয়ে বলেন, ‘মধ্য এশিয়া ওই সময় ছিল শিক্ষাদীক্ষার একটা বড় কেন্দ্র। এখানে আমরা অনেক বিশ্বমানের বিজ্ঞানীর জন্ম দিয়েছি।’


জ্ঞানের নগরী


ইতিহাসবিদ ইসমাইলভের দেখা পেতে আমাকে জনমানবহীন উস্তায়ুর্ত মালভূমির মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া নিঃসঙ্গ রেললাইন ধরে ২৪ দিন হেঁটে যেতে হয়েছে খিভা নগরীতে।


খিভা হলো এক মরূদ্যান শহর। মধ্যযুগে রেশম পথের ক্যারাভানগুলো এ শহরে যাত্রাবিরতি করত। উনিশ শতকে এসে মাটির দেয়ালঘেরা এ শহরটির প্রভাব-প্রতিপত্তি বলতে গেলে শূন্যের কোটায় নেমে যায়। একসময় এ শহরসহ সমগ্র মধ্য এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে কতই না যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে!


তবে খিভা শহরটি আমাকে টেনেছে অন্য একটি কারণে। অষ্টম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত খিভা, বাক্সোরো, সমরখন্দ - উজবেকিস্তানের এসব শহর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় ইউরোপের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। ওটা ছিল বিজ্ঞান, কলা ও সংস্কৃতিতে আরবদের স্বর্ণযুগ, যখন দূরপ্রাচ্যের খেলাফতবলয় থেকে আসা প্রাজ্ঞজনদের সাদরে গ্রহণ করত বাগদাদ নগরী। এ রকম একজন হচ্ছেন আল-খারিজমি, যিনি বীজগণিত উদ্ভাবন করেছিলেন, নির্ণয় করেছিলেন ভূমধ্যসাগরের দৈর্ঘ্য (যা পরে সংশোধন করেন টলেমি)। মধ্য এশিয়ার বহু শাস্ত্রবিশারদ আল-বেরুনি লিখেছিলেন শতাধিক বই, যার মধ্যে আছে ভারতের বিস্তারিত নৃতত্ত্ব নিয়ে একটি বই এবং একটি সমীক্ষা, যার শিরোনাম ‘ছায়াবিষয়ক রচনাবলি’। এতে তিনি লিখেছেন, ‘জ্বিন হচ্ছে ভুল আত্মার নাপাক অংশ। দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর এসব আত্মাকে আর তাদের আদি উৎসে ফিরতে দেয়া হয় না। কারণ, তাদের সত্যের জ্ঞান নেই, তারা বাস করে সংশয় সম্মোহনের ভেতরে।’ তার এ বক্তব্যটি আমার যথার্থ মনে হয়েছে।


সত্যি বলতে কী, রেশমপথের বাজারগুলো যেন বহুজাতির মিলনমেলা। এখানে নবজাগ্রত ইউরোপের মানুষ যেমন ছিল, তেমনি ছিল প্রাচীন ধারার গ্রীক, ভারতীয়, ইরানি ও চীনের মানুষ। তাদের মিলিত কোলাহলে বুদ্ধিবৃত্তিক বিস্ফোরণ ঘটত। ইসলামের ইতিহাসে মুতাজিলা নামে যুক্তিবাদী গোষ্ঠীর আবির্ভাব এ বিস্ফোরণেরই ফল। এ গোষ্ঠী বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছাড়া কিছুই গ্রহণ করতে চাইত না।


তবে শেষ পর্যন্ত ওরা টিকতে পারেনি। গোষ্ঠিদ্বন্দ্বে খেলাফতব্যবস্থা ভেঙে পড়লে আশারিয়া নামে শুদ্ধতাবাদী গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। তারা চিন্তাজগতের এসব ‘বহিরাগত উপাদানের’ মূলোৎপাটন করে। ১২৫৮ সালে মোঙ্গলরা বাগদাদ আক্রমণ ও ধ্বংস করে ফেলে। এর মধ্য দিয়ে ধ্বংস হয়ে যায় একটি আলোকিত যুগ।


উজবেকিস্তানের পথে


আমরা চলছি কর্তৃত্ববাদী উজবেকিস্তানের পথ ধরে। পথ চলতে গিয়ে ৩৪ বার পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয় আমাদের।


আমু দরিয়ার পাড়ের গ্রামগুলোর ভেতর দিয়ে চলতে চলতে যখনই আমরা কোনো গ্রামবাসীর কাছাকাছি গেছি, তখনই তারা আমাদের ক্যারাভানকে তাদের গাড়ির দরজা, এপ্রিকট ফলের বাগান কিংবা তরমুজক্ষেত থেকে দূরে সরে যেতে বলেছে।


চিরাচরিত অতিথিপরায়ণ গ্রামবাসীর এ আচরণ কেন? গ্রামবাসী সবিনয় ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেছে, ‘(তোমাদের আপ্যায়ন করে) আমরা পুলিশি ঝামেলায় পড়তে চাই না।’ বলেছে বটে, তার পরও মেহমানদারির তাড়না থেকেই বুঝিবা তাদের শিশুসন্তানদের হাতভরতি গরম গরম সুস্বাদু নান (রুটি) দিয়ে আমাদের কাঠে পাঠিয়েছে।


কাজাখস্তানের নেকড়েশিকারি করিম জুনেলবেকভকে একবার আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা, ধরো, এই সিল্ক রোড ধরে চলতে চলতে আমি কোনো জ্বিনের পাল্লায় পড়ে গেলাম। কী করতে হবে তখন?’


করিম জবাব দেয়, ‘কোনো ব্যাপার না। একটুও ভয় পাবে না। কাঁপবেও না। জাস্ট একটা পাথরের ওপর গিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে। বসেই থাকবে। তোমার নড়াচড়া না দেখে জ্বিনটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে আর তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে।’


ভীতির দেশে এর চেয়ে ভালো পরামর্শ আর কী হতে পারে!


আমরা চলছি অরাল সাগরের তীর বেয়ে। পতিত সোভিয়েত আমলে ‘সাদা সোনা’ অর্থাৎ তুলা উৎপাদনের জন্য সেচকাজ চালাতে গিয়ে এ সাগরটিকে প্রায় মেরে ফেলা হয়।


তুর্কি বিজেতা তৈমূর লংয়ের রাজধানী সমরখন্দ নগরীতে আমরা দেখলাম পৃথিবীর শেষ প্রাচীন কাগজকলটি। মধ্য এশিয়ায় কাগজ ব্যবহারের প্রাচীনতম নমুনাটি চতুর্থ শতাব্দীর। পরিভ্রমণশীল স্বামীকে (সম্ভবত ব্যবসায়ী) এক তোড়া কাগজে ১৭০০ বছর আগে চিঠি লিখেছিলেন এক নারী। ‘প্রিয়জন’ সম্বোধন করে লেখা চিঠিটি কখনোই প্রাপকের কাছে পাঠানো হয়নি। স্বামীর বিরহে বেদনাবিধুর নারীটি লিখেছিলেন, ‘তোমার না হয়ে কোনো কুকুর বা শূকরের বউ হলেও ভালো হতো।’


রেশমের শহরে


২০১৬ সালের নভেম্বরে আমরা যাই উজবেকিস্তানের একমাত্র রেশম উৎপাদনকারী শহর মারগিলনে। দৃষ্টিহীন, পাখাবিহীন একধরনের পোকা থেকে উৎপাতি হয় রেশম। এই রেশমের চাষ, উৎপাদন ও বিপণন করে প্রাচীনকালে মধ্য এশিয়ার ব্যবসায়ীরা এতই সমৃদ্ধ হন যে, তারা পান করতেন বিশুদ্ধ পানি, যখন লন্ডন নগরীর মানুষও তা পেত না। এই রেশমতন্তুই একসময় গোটা দুনিয়াকে একসূত্রে বেঁধে ফেলেছিল, যা করার ক্ষমতা কোনো জ্বিনেরও ছিল না।


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com