শিরোনাম
ভালোবাসার কাছে মাতৃত্বের পরাজয়
প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০১৮, ১৮:০৭
ভালোবাসার কাছে মাতৃত্বের পরাজয়
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

বাস্তবের অনেক ঘটনা সিনেমাকেও হার মানায়। তেমনই এক ঘটনার জন্ম ভারতের আসাম রাজ্যে। হাসপাতালে বাচ্চা বদল হয়ে যায় দুই পরিবারের। কিন্তু কেউ জানতে পারে না। আর সত্যটা যেদিন জানা যায়, সেদিন বাচ্চাদের কেউ ফিরে যেতে চায় না তাদের আসল মা-বাবার কাছে।


হিন্দু-মুসলিম পরিবারের মধ্যে বাচ্চা বদলের এই ইতিহাস হয়েছে খবরের শিরোনাম।


ঘটনা ২০১৫ সালের ১১ মার্চের। আসামের বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন আহমেদের স্ত্রী সালমা পারভিনের প্রসব বেদনা শুরু হয়। স্থানীয় মঙ্গলধায়ী সিভিল হাসপাতালে স্ত্রীকে ভর্তি করেন তিনি। সেদিন সন্ধ্যা ৬টায় পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। পরের দিন হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয় সালমা পারভিনকে।


এক সপ্তাহ পর শিশু জোনায়েদ তার সন্তান নয় বলে সালমা পারভিন তার স্বামী শাহাবুদ্দিনকে জানান। স্ত্রীর মুখে এ কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না শাহাবুদ্দিন।


তিনি বলেন, নিষ্পাপ শিশুদের নিয়ে এমন কথা বলতে নেই। কিন্তু তার স্ত্রী শিশুর শরীরের বর্ণনা দিয়ে বলেন, এমন শিশু বোড়ো উপজাতিদের হয়।


সালমার মতে হাসপাতালে তাদের সঙ্গে অন্য কারোর শিশু বদল হয়ে গেছে। এমন সন্দেহ তার শুরু থেকেই ছিলো। তার এই সন্দেহের পেছনে যুক্তি, একই দিনে ওই হাসপাতালে তাদের বিছানার পাশে বোড়ো হিন্দু উপজাতি এক দম্পতির সন্তান জন্ম হয়। বোড়ো উপজাতিদের সন্তানের চোখ ছোট ছোট হয়। সালমার পরিবারের কারো চোখ ওরকম নয়।


স্ত্রীর সন্দেহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানায় শাহাবুদ্দিন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সালমাকে মানসিক রোগী বলে সাব্যস্ত করেন। তাকে মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার নসিহত করেন। নিজেদের ভুল স্বীকার করতে রাজি ছিলো না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।


কিন্তু দমে যাবার পাত্র নন শাহাবুদ্দিন। সেদিন জন্ম নেয়া প্রতিটি শিশুর বিস্তারিত জানতে চেয়ে আদালতে আবেদন করেন তিনি। কাদের সঙ্গে তার সন্তান বদল হয়েছে, সে খবর জানতে চান তিনি। একমাস পর শাহাবুদ্দিনের কাছে ৭ নারীর সন্তান ভূমিষ্ঠর রেকর্ড আসে। প্রত্যেক সন্তানের বিস্তারিত বিবরণ সেখানে ছিলো। এদের মধ্যে একজনের সঙ্গে তার ছেলের বর্ণনা মিলে যায়।


যার সঙ্গে মিলে যায় তিনি একজন বোড়ো উপজাতির হিন্দু। তার বাচ্চার ওজন ৩ কেজি। সন্তান জন্মের সময় একই। শুধু ফারাক ৫ মিনিটের। এই উপজাতি নারীর পরিচয় ও ঠিকানা পান তিনি। অনিল ও শিওয়ালি বোরো সন্তান রিয়ান চন্দ্রই হচ্ছে তাদের আসল সন্তান। তারা শাহাবুদ্দিনের বাড়ি থেকে ৩০ কিমি দূরে থাকে।


শাহাবুদ্দিনের চিঠি পাওয়ার আগ পর্যন্ত ওই দম্পতির মনে তাদের সন্তান নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। চিঠির পরই তাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। এমন ভুল হতে পারে? তা তাদের পরিবারের কেউ মেনে নিতে চাচ্ছিলো না।


সালমা পারভীন প্রথম সাক্ষাতেই বাচ্চা ফেরত নেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু শিওয়ালি বোরো এতে রাজি ছিলেন না।


এদিকে শাহাবুদ্দিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এ নিয়ে অনুসন্ধানের আর্জি জানান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে তাদের ভুলের বিষয়ে। সালমা পারভীন তার শিশুর ডিএনএ নমুনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দেখায়। যেখানে তাদের সঙ্গে শিশুর ডিএনএ মিলছে না বলে জানানো হয়। কিন্তু আইনের দোহাই দিয়ে এই ডিএনএ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।


অগত্যা একই বছর পুলিশের কাছে অভিযোগ করে শাহাবুদ্দিন পরিবার। আদালতের নির্দেশে উভয় পরিবারের রক্তের নমুনা কলকাতায় আনা হয়। কিন্তু সেখানকার ফরেনসিক বিভাগ রাজি হয়নি পরীক্ষা করতে। এরপর ২০১৭ সালের এপ্রিলে দুই পরিবারকে গোহাটিতে আনা হয়। সেখানে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয় দুই সন্তানের। নভেম্বরে সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এতে প্রমাণিত হয় শাহাবুদ্দিনের ছেলে বদল হয়ে গিয়েছিলো।



গত ৪ জানুয়ারি আদালতে দুই সন্তানকে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু দুই পরিবারের সন্তান রাজি ছিল না তাদের নতুন (আসল) বাবা মাকে গ্রহণ করতে।


এদিকে আদালত উভয় পরিবারকে সন্তান বদল করে নিতে অনুমতি দেয়। কিন্তু সন্তানরা যেভাবে কান্নাকাটি করে, তাতে কারো বাবা মা তাদের পালক সন্তানকে দূরে ঠেলে দিতে পারেনি। তিন বছর আদর ভালোবাসা পাওয়ার পর শাহাবুদ্দিন-সালমা দম্পতির কাছে পালিত জোনায়েদ চাচ্ছে না তার আসল বাবা মায়ের কাছে ফিরে যেতে। তেমনি অনিল-শিওয়ালি দম্পতির কাছে পালিত রিয়ানও চাচ্ছে না তার আসল বাবা মায়ের কাছে ফিরতে।


তাই সালমা ও শিওয়ালি কেউই পারেনি তাদের ইচ্ছা অনুসারে সন্তান বদল করে নিতে। এখানে সন্তানদের আবেগের কাছে উভয় পরিবারের মায়েরা পরাজিত। তাই আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও দুই পরিবার তাদের সন্তানদের বদল করে নিতে পারছে না। কারণ শিশুরা বোঝে ভালোবাসা, আদালতের রায় নয়। সূত্র বিবিসি


বিবার্তা/সুমন/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com