শিরোনাম
ঘুষের গল্প
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ১৬:৪১
ঘুষের গল্প
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ঘুষ অনেকটাই যেন সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে গেছে বাংলাদেশে। টিআইবি'র এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন সেবা পেতে বছরে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। তবে ৯০ ভাগ মানুষ ঘুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চায়।


দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি অমিতোষ পাল ঘুষ নিয়ে একাধিক আলোচিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন। বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের ঘুষবাণিজ্য নিয়ে তার প্রতিবেদনগুলো আলোচিত।


অমিতোষ পাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সিটি কর্পোরেশনের যে কোনো কাজে ঠিকাদারকে কাজ পাওয়া থেকে শুরু করে বিল নেয়া পর্যন্ত ধাপে ধাপে ঘুষ দিতে হয়। যত ধাপ তত ঘুষ - এটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।''


অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি আরো বলেন, ‘‘ধরা যাক একটি সড়কের কাজের শুরু হয় দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আর দরপত্র দাখিলের পর থাকে একটি মূল্যায়ণ কমিটি। কাজ পেতে হলে শুরুতেই এই কমিটিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুষ দিতে হয়। কাজটা পাওয়ার পর যাদের কাজ বা যারা টেন্ডার আহ্বান করেছে সেই নির্বাহী প্রকৌশলীকে টাকা দিতে হয়। এরপর ফাইলটি উপরে উঠতে যেসব ধাপ পেরোতে হয় তা হলো, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও মেয়র। এই ধাপগুলো পেরিয়ে তবেই কার্যাদেশ পাওয়া যায় আর এর প্রতিটি ধাপেই টাকা দিতে হয়। তবে অল্পকিছু সৎ কর্মকর্তাও আছেন, যারা ঘুষ নেন না।''


অমিতোষ পাল জানান, ‘‘কাজটি শেষ হওয়ার পর বা মাঝখানে ঠিকাদারকে বিল পেতে আবার একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। তখন ওই ধাপগুলো ছাড়াও ঘুষের তালিকায় আরো একটি বিভাগ যোগ হয় - অ্যাকাউন্টস সেকশন। সব মিলিয়ে যদি এক কোটি টাকার কাজ হয় তাহলে তার ৩০ ভাগ মানে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ হিসেবেই পরিশোধ করতে হয় ঠিকাদারকে। এরপর ভ্যাট-ট্যাক্স মিলিয়ে দিতে হয় আরো প্রায় ২০ ভাগ। ঠিকাদার যদি কমপক্ষে ১০%ও লাভ করেন তাহলে এক কোটি টাকার টেন্ডারে কাজ হয় ৪০ লাখ টাকার। কিন্তু ঠিকাদাররা ২০%-৩০% লাভ করেন। তাই শেষ পর্যন্ত এক কোটি টাকার কাজ বাস্তবে হয় ২০-৩০ লাখ টাকার।''


তিনি আরো বলেন, ‘‘এ কারণেই একটি সড়ক যেখানে পাঁচ বছর টেকার কথা, সেটি এক বছরের বেশি টেকে না।''


তিনি বলেন, ‘‘সিটি করপোরেশনে একটি কাজে ঠিকাদারদের অন্তত ১৬ ধাপে ঘুষ দিতে হয় - এটা প্রচলিত।''


বাংলাদেশে এই সময়ে আলোচিত একটি ঘুষের ঘটনা হল এক ওসি'র। গত ২৭ ডিসেম্বর নরসিংদীর মনোহরদী থানার ওসি গাজী রুহুল ইমাম ওই এলাকার ব্যবসায়ী আসলাম শেখের কাছে ঘুষ হিসেবে ৬৫ ইঞ্চি এলসিডি টিভি দাবি করে, যার দাম তিন লাখ ৬৫ হাজার টাকা।


আসলাম শেখ ও তার ভাই সালাম শেখকে ভুয়া ডাকাতির মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে ঘুষ হিসেবে ওই টিভি দাবি করে ওসি রুহুল। দাবি অনুযায়ী টেলিভিশন না দেয়ায় পুলিশ পাঠিয়ে তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের হেনস্তা করায় ওসি। এমনকি টেলিভিশন না-দিলে এলাকাছাড়া করার এবং ডাকাতি মামলায় জেল খাটানোরও হুমকি দেয় ওই ওসি।


ঘুষ হিসেবে টেলিভিশন দাবির ফোনালাপের রেকর্ড সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর অবশ্য ওই ওসিকে ''প্রত্যাহার'' করা হয়েছে।


ভুক্তভোগী আসলাম শেখ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমি থানায় একটি জিডি করতে গিয়ে ওসি'র টার্গেটে পরিণত হই। এরপর ৬৫ ইঞ্চি টিভি ঘুষ দাবির টেলিফোন রেকর্ড সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হলে আমি রক্ষা পাই।''


আসলাম শেখ জানান, ''ওসিকে প্রত্যাহারের পর এখন অনেক ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে। মনোহরদীর অনেকেই মুখ খুলছেন। ওসি'র ঘুষ আদায়ের নানা কৌশল ও কাহিনী প্রকাশ পাচ্ছে।''


থানায় ঘুষের অভিজ্ঞতার কথা ডয়চে ভেলেকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, ‘‘নির্মাণকাজে চাঁদা দাবির ব্যাপারে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়ে আমার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রথমে মামলা করতে টাকা লেগেছে। এরপর আসে আসামি ধরার পালা। সেখানেও টাকা ছাড়া পুলিশ আসামি ধরবে না। দিলাম টাকা। কিন্তু মূল আসামিদের না ধরে এলাকার কয়েকজন নিরপরাধ লোককে ধরে আনে পুলিশ। এবার আমার উল্টো বিপদ। তাদের ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলে পুলিশ আমার কাছেও টাকা চায়, আটকদের কাছেও টাকা চায়। পরে অবশ্য আটকরা পুলিশকে কিছু দিয়ে ছাড়া পায়।''


তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি দেখলাম মামলা করে উল্টো আমিই বিপদে। পুলিশ ধীরে ধীরে আসামিদের প্রতি সদয় হয়। জানতে পারি, তাদের কাছ থেকেও পুলিশ টাকা নিয়েছে৷। মামলার তদন্ত এগোয় না। আমি তদবির করতে গেলে পুলিশ উল্টো বিরক্ত হয়। আর একদিন পুলিশ আমাকে আসামিদের ‘এলাকার ছেলেপেলে' বলে সমঝোতা করে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। তারপর আমি মামলাটি নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।''


২০১৬ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বাংলাদেশের ১৬টি সেবাখাতে ঘুষ নিয়ে একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে। জরিপটি হয় ২০১৫ সালে। এতে দেখা যায়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পাসপোর্ট ও বিচারিকসহ ১৬টি খাতের সেবা পেতে বছরে ৮,৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় সেবাপ্রার্থীদের।


জরিপে অংশ নেয়া নাগরিকদের ৬৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ সেবা পেতে ঘুষ দেয়ার কথা জানিয়েছেন৷ আর ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ জানিয়েছেন যে তারা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন।


২০১৫ সালের পর টিআইবি আর ঘুষ নিয়ে জরিপ করেনি। তবে অবস্থার কোনো উন্নতি হয়েছে - এমন কোনো তথ্যও তাদের কাছে নেই।


ওই জরিপে আরো বলা হয়, ২০১৫ সালে পাসপোর্ট খাতে সেবা নিতে গিয়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি মানুষ ঘুষবাণিজ্যের শিকার হয়েছেন। ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশকে পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দিতে হয়েছে। আর পাসপোর্ট অফিসের ১০০ জনের মধ্যে ৭৬ জনই ঘুষ নিয়েছেন।


২০১৫ সালে ভূমি প্রশাসন খাতে প্রায় ২,৪৫০ কোটি টাকা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় ১,৭০২ কোটি, বিদ্যুৎ খাতে ১,৬১৩ কোটি, বিচারিক সেবা খাতে ৮০৮ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে সর্বাধিক মানুষ ঘুষের কবলে পড়লেও এ খাতে ঘুষের পরিমাণগত অবস্থান সপ্তম - ২৯৫ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ঘুষ লেনদেন হয়েছে ১৯২ কোটি টাকা।


গড় হিসেবে গ্যাস সংযোগ নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয়েছে৷ প্রতিটি খানায় যার গড় পরিমাণ ২৭,১৬৬ টাকা। এছাড়া বীমা খাতে ১৩,৪৬৫ টাকা, বিচারিক সেবায় ৯,৬৮৬ টাকা এবং ভূমি প্রশাসনে ৯,২৫৭ টাকা দিতে হয়েছে।


টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জরিপে এটাও উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের ৬৭.৮% মানুষ ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন। এর মানে হলো, এখানে ঘুষ না দিলে কাজ হয় না, সেবা পাওয়া যায় না। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ঘুষ বাংলাদেশের অন্যতম সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর অন্যতম কারণ হল ঘুষখেলে বা দিলে যে শাস্তি পেতে হয়, বিচারের মুখোমুখি হতে হয় - এটা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘুষ খেয়ে পার পাওয়া যায়। সরকারি কর্মচারিদের বেতন বাড়ানোর সময় আশা করা হয়েছিল ঘুষের প্রবণতা কমবে। কিন্তু কমেনি। আর ঘুষ খাওয়ায় সাথে অর্থনৈতিক দুরবস্থার সম্পর্কও এখানে প্রমাণিত নয়। কারণ, যে যত বড় পদে থাকে, সে তত বেশি ঘুষ খায়।''


ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘দুর্নীতিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা মূল ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ঘুষের ক্ষেত্রে সেটা সেটাও না-ও হতে পারে। সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশে ঘুষ এখন আর সামাজিকভাবে নিন্দিত নয়, এটা অনেক সময় বাহবাও পায়, যা ভয়াবহ।''


বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঘুষবিরোধী মনোভাব বেশ প্রবল বলেই মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘‘টিআই'র এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ নিরাপত্তা ও ভরসা পেলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চায়।''


বিশ্লেষকরা অবশ্য মনে করেন, বাংলাদেশে ঘুষ সংস্কৃতি কমে আসার একটি শুভ লক্ষণও দেখা গেছে। তা হল যে খাত যতটা বেশি ডিজিটালাইজড হচ্ছে সেই খাতে ঘুষ তত কমছে। বাংলাদেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টারগুলো থেকে সেবা পেতে তেমন ঘুষ দিতে হয় না। তাই ঘুষ বন্ধে বিভিন্ন সেবা খাততে দ্রুত ডিজিটাল করার পরামর্শ দিয়েছেন টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক। সূত্র : ডয়চে ভেলে


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com