শিরোনাম
আসলে কেমন আরব দুনিয়া
প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১৬:০৫
আসলে কেমন আরব দুনিয়া
হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
প্রিন্ট অ-অ+

অনেক দেশ, কিন্তু ভাষা এক


মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার ২২টি আরব দেশের একটিই ভাষা - আরবি। এই ভাষাটি তাদের বেঁধে রেখেছে অদৃশ্য এক ঐক্যের সুতায়। যদিও এই আরবির কথ্যরূপটি এক দেশ থেকে অন্য দেশের বেলায় আলাদা, কিন্তু লিখিত রূপটি হুবহু এক। কাজেই আপনি কোন দেশের, সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে পবিত্র কুরআনের ভাষাই আপনার ভাষা।


আরব বিশ্বের প্রায় সব দেশের সাথে ইসরাইলের সুসম্পর্ক নেই। কিন্তু ইসরাইলিদের ভাষা হিব্রুর মতো আরবিও একটি সেমেটিক ভাষা, যদিও আরবি ভাষাটি লিখিত হয় যুক্ত অক্ষরে।


আরবি একটি বিশাল ও সুমার্জিত ভাষা। এর ব্যাকরণ ও বাগরীতি আয়ত্ত করা বিদেশীদের জন্য কঠিনই বটে। যেমন ‘আম্মান’ হচ্ছে জর্দানের রাজধানী এবং ‘ওমান’ একটি আরব দেশ। দু’টি আলাদা শব্দ, কিন্তু আরবরা যখন উচ্চারণ করে তখন বোঝা মুশকিল হয়ে যায় যে, আম্মান বলল নাকি ওমান।


গড়পড়তা হাজার তিনেক ইংরেজি শব্দের অর্থ জানা থাকলে একটি ইংরেজি টাবলয়েড পত্রিকা দিব্যি পড়া যায়। কিন্তু আরবির বেলায় এত কম শব্দে চলবে না। একটি আরবি পত্রিকা পড়ে বুঝতে হলে জানা থাকা চাই অন্তত ১০ হাজার আরবি শব্দ। আরবি ভাষায় প্রকাশভঙ্গির বিশালতার এটা একটা বড় প্রমাণ।


এ ছাড়া এই ভাষাটি কাব্যিক ও আলঙ্কারিক। আরব দেশীয় বক্তারা, যেমন রাজনৈতিক নেতা কিংবা ওয়ায়েজিন, ভাষার এই দিকটা ভালোভাবেই কাজে লাগান। শ্রোতারা যেখানে বেশির ভাগই নিরক্ষর, সেখানে তাদের প্রভাবিত করতে তারা আরবি কাব্য ও অলঙ্কারবহুল ভাষা ব্যবহার করেন। ইরাক ও লিবিয়ার দুই সাবেক একনায়ক যথাক্রমে সাদ্দাম হোসেন ও কর্নেল গাদ্দাফি এ কাজটি সাফল্যের সাথেই করে গেছেন।


এরা ছাড়া সাধারণ আরবরাও তাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় ব্যবহার করে নানারকম প্রবাদ-প্রবচন, ছড়া ও ধাঁধা। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একটি গ্রামেই এ রকম চার হাজারের বেশি শব্দের খোঁজ মিলেছে। এগুলো এতই মৌলিক যে, সত্যি বলতে কি, অনুবাদে এর রূপ-রস পুরোটাই হারিয়ে যাবে। তবুও মধ্যপ্রাচ্যে জনপ্রিয় কয়েকটি প্রবাদ-প্রবচন নিচে দেয়া হলো:


নিয়তি যত্ন নেয় অল্প কিছু মানুষের, আর বেশির ভাগকেই করে পীড়ন।


যে তার গাধাকে চূড়ায় নিয়ে যায়, তাকে তা আবার নামিয়েও আনতে হয়।


চরম ক্রোধের একটি মুহূর্তে ধৈর্য ধরতে পারে যে, সে যেন তার ১০০ দিনের দুঃখকষ্ট থেকে রেহাই পেল।


যে পাখি অনেক উঁচু দিয়ে উড়তে পারে না, আল্লাহ তার জন্য বানিয়ে দিয়েছেন (গাছের) নিচু ডাল।


আগামীকালকে কে দেখেছে?


আরব দেশগুলোর একটি জনপ্রিয় প্রবাদ এটি। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে অবশ্যই ‘টাইম ইজ মানি’ এই পশ্চিমা প্রবচনটি কার্যকর নয়। এখানে কম সময়ে কাজ সারার চেষ্টা কোনো প্রশংসনীয় ব্যাপার নয়। বরং ধৈর্যই এখানে সাফল্যের চাবিকাঠি।


ভালোভাবে কাজ সারতে হলে তাই ধৈর্যের চর্চা আবশ্যিক। অধৈর্য হবেন তো মরেছেন। কেননা মধ্যপ্রাচ্য এমন একটি অঞ্চল, যেখানে একটি কাজ কতক্ষণে সারা হলো তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষা।


গর্বিত জাতি


আরব বসন্তের কথা মনে আছে? এখানে সমবেত হওয়ার ডাক দেয়া হয়েছিল কারামাহ বা ‘মর্যাদা রক্ষার’ নামে। বস্তুত আরব বিশ্বে মর্যাদা ও গর্ব একটি বড় ব্যাপার। আর এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাবই রয়েছে।


আরব সমাজে চুরি, ধর্ষণ, হামলা ইত্যাদি পাশ্চাত্যের তুলনায় অনেক কম। এর একটি কারণ হচ্ছে কঠোর শাস্তির ভয়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, আরবরা কেউ তাদের পরিবারকে হেয় করতে চায় না।


অবশ্য মর্যাদাবোধের বিষয়টি অনেক সময় বিবাদ-বিসম্বাদের দিকেও গড়ায়। যেমন, অনেক আরব গোত্রের মধ্যে বংশপরম্পরায় সঙ্ঘাত চলে আসছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও ইরাকের বিশৃঙ্খলা আগামী দিনগুলোতে সেখানকার বিবদমান গোষ্ঠীগুলোর প্রতিশোধ গ্রহণের মারণখেলায় রূপ নেয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হয়।


মেহমান মেহমানই, তা তিনি যত দিন থাকুন


আরবদের মেহমানদারি কিংবদন্তিতুল্য - সে কথা সবার জানা। এ প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দুই পশ্চিমা সাংবাদিক লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালের কথা। জন ভ্রমণ করছিল সিরিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে। তার ইচ্ছা, সেখানে ক্যাম্প করে কিছু দিন থাকবে। কিন্তু তার পকেটে একটা পয়সাও নেই। কিন্তু তাতে কী, গ্রামবাসী আছে না! তারা তাকে জোরাজুরি করে, তুমি আমাদের সাথে থাকো। এক মা তো কেঁদেই ফেললেন জনের মায়ের কথা ভেবে যে, ছেলেকে এত দূরে রেখে তিনি কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন।’


এখানকার মেহমানদারির ঐতিহ্য এতটাই জোরদার যে, আপনি গৃহকর্তার কোনো জিনিসের প্রশংসা করলেই তিনি সেটি মেহমানকে দিয়ে দেয়া দায়িত্ব মনে করেন। ডায়ানা নামে এক পশ্চিমা ছাত্রী একবার এক বেদুইন গোত্রের সাথে কিছু দিন ছিলেন। একদিন তিনি বেদুইনদের একটি সাদা উটের-বাচ্চার খুব তারিফ করেন। পরে একদিন তাঁবুতে ডায়ানার সম্মানে জমকালো ভোজের আয়োজন করা হয়। তার পর থেকে ডায়ানা ওই উটের বাচ্চাটি আর দেখতে পাননি।


দুঃখজনক হলেও সত্য, এই গৌরবময় ঐতিহ্যে এখন চিড় ধরতে শুরু করেছে। অন্য কিছু নয়, যুদ্ধই এর কারণ। যুদ্ধের ফলে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অসংখ্য আরব।


নিজে বাঁচে না, মেহমানদারি করবে কিভাবে?


শিশুরা স্বাগত


আরবরা শিশুদের অসম্ভব রকম ভালোবাসে। তাই কোনো আরবের মুখোমুখি হলে প্রথমেই আপনি যে ক’টি প্রশ্ন পাবেন তার একটি হলো ‘আপনার ছেলেমেয়ে ক’টি?’ যত বেশি তত ভালো। যদি বলেন, ‘একটাও নেই’ তবে ওরা আপনার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাবে এবং তারপর অসংখ্য প্রশ্ন : কেন নেই? ডাক্তার দেখিয়েছেন? কার দোষ… ইত্যাদি।


আরব দেশের রেস্তোরাঁগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, খেতে আসা কোনো পরিবারের সাথে রয়েছে তাদের একেবারে ছোট শিশুটিও। কারণ, তারা চান ওই ছোটটিও তাদের মতো আনন্দ করবে এবং তারা যা খায় তা-ই খাবে। এই সমাজে বড়রা ছোটদের খুবই ভালোবাসেন। তাই বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় ছোটদেরকে বাড়িতে বা বেবিসিটারের কাছে রেখে যাওয়াকে অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ মনে করা হয়।


কেউ যেন আমাকে দেখছে


কুসংস্কারও আরব সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এসব কুসংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত হচ্ছে ‘ভূতের চোখ’। অনাদিকাল থেকে আরবসমাজে এই অপবিশ্বাসটি আছে। মনে করা হয়, কারো ওপর এই অশুভ দৃষ্টি পড়লে তার জীবনে অমঙ্গল নেমে আসে। এর কুপ্রভাব এড়াতে আরবরা তাদের বাড়ি ও গাড়িতে সিরামিক প্লেটে চোখের আকৃতির তাবিজ-কবচ ঝুলিয়ে রাখে। ‘ভূতের চোখ’কে সাধারণত নীল বলেই মনে করা হয়। আর বিদেশী, বিশেষত পশ্চিমারা যেহেতু নীল চোখের অধিকারী, তাই তাদের দেখলেই চোখ বড় হয়ে যায় আরবদের।


এ ছাড়া আরো একটি বিষয় আছে। মনে করা হয়, কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর বাড়াবাড়ি রকম প্রশংসা করলে সে ক্ষেত্রে তার ক্ষতি হতে পারে (বাংলাদেশে যেটাকে ‘বদনজর পড়া’ বলে মনে করা হয়)।


আরবদের আরেকটি সৌভাগ্যের চিহ্ন হচ্ছে হজরত ফাতিমা রা.-এর হাত। এটি তারা দরজায় ঝুলিয়ে রাখে। তাদের বিশ্বাস, এতে তাদের বাড়ি ও বাড়ির লোকজন নিরাপদ থাকবে।


এ ছাড়া জিনে বিশ্বাসও মধ্যপ্রাচ্যে একটি সাধারণ ঘটনা। পবিত্র কুরআনে জিনের উল্লেখ রয়েছে। অশরীরী এই প্রাণী ভালো ও খারাপ দুই রকমই হতে পারে।


ভেড়ার চোখ ও ঢেঁকুর তোলা


আরবদের ভদ্রতাবোধ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে কিছু মজার ধারণা চালু আছে। যেমন, একটি ধারণা হলো, আপনি ঢেঁকুর তুলে গৃহকর্তাকে জানিয়ে দেবেন যে, ‘খানা খুব ভালো হয়েছে। অনেক খেয়েছি। আর না।’ এই ধারণাটি চালুর কারণ হলো আরবি শব্দ শাবা’ত উচ্চারণের সময় ঢেঁকুর তোলার শব্দের মতো শোনায়। আসলে এর অর্থ হলো, ‘অনেক খেলাম’। এর মাধ্যমে বিনয়ের সাথে জানিয়ে দেয়া হয় যেন তার পাতে আর কিছু ঢালা না হয়।


ভেড়ার চোখ আরবে তেমন প্রচলিত খাদ্য নয়। তার পরও পাশ্চাত্যে এ নিয়ে একটি ধারণা চালু হয়ে গেছে। এর মূলে আছেন এক ব্রিটিশ কূটনীতিক। ওই কূটনীতিককে একবার এক উপজাতীয় শেখ নৈশভোজের দাওয়াত দেন। খানার টেবিলে তিনি মেহমানকে ভেড়ার দু’টি চোখ দেখান এ জন্য যে, মেহমান যেন বুঝতে পারেন এই গোশত একেবারে তরতাজা। কিন্তু ভুল বোঝেন কূটনীতিক। তিনি মনে করেন এটি বুঝি আরবের বিশেষ কোনো ভোজনপদ। তিনি তাই একটি চোখ পাতে তুলে নেন এবং খেয়ে ফেলেন। বিপন্ন শেখ মেহমানের ভুল শুধরে দিয়ে তাকে বিব্রত করতে চাননি এবং মেহমানের সম্মান রক্ষার্থে অপর চোখটি তিনি নিজেই খেয়ে নেন।


যুববিস্ফোরণ


আরব বসন্ত কেন হয়েছিল? সে কি শুধু ওসব দেশের শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন-নিপীড়ন ও অপশাসনের কারণে? অংশত তো বটেই। তবে এর পেছনে সক্রিয় অন্য কারণটির কথা কেউ বলে না। সেটি হলো জনসংখ্যা বিস্ফোরণের টাইম বোমা। ভেবে দেখুন, ২২টি আরব দেশের ৩৫ কোটি জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি ২৫ বছরের কম বয়সী। এই বিপুল যুবগোষ্ঠীর বেকারত্বের হারও অতি উচ্চ। আর এ কথা কে না জানে যে, বেকার তরুণ-যুবারাই যেকোনো বিপ্লবের যথাযোগ্য সূচনাকারী!


আরব তরুণদের অনেকেই লেখাপড়া জানে। তারা প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত। তারা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইউটিউব, টুইটার ও ফেসবুক ব্যবহার করে। সামাজিক যোগাযোগের এসব মাধ্যম আরব বিশ্বে এখন পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত।


পর্দার পেছনে ক্ষমতা


আরব সংস্কৃতি ও ইসলাম ধর্ম দুটোই নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো-না-কোনো মাত্রায় পৃথকীকরণ রাখার পক্ষপাতী। বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাশ্চাত্যে বেশ মাতামাতি চলছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নারীরা পর্দার অন্তরালে থাকা মানে তারা একেবারে ক্ষমতাহীন তা কিন্তু নয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে যেসব শিক্ষার্থী, তাদের মধ্যে ছেলের চেয়ে মেয়ের সংখ্যা অনেক বেশি।


সৌদি আরব ছাড়া আর সব আরব দেশে মেয়েরা গাড়ি পর্যন্ত চালাচ্ছে। বেশির ভাগ আরব দেশে মেয়েরা বিয়ের পর নিজ নামের শেষে স্বামীর নাম যুক্ত করে না। আর বাড়িতে টাকা-পয়সার হিসাব নিয়ন্ত্রকও প্রায় ক্ষেত্রেই তারা।


বৃষ্টির জন্য হাহাকার


আরব বিশ্বে জনসংখ্যা ও নগরায়ন যতই বাড়ছে, ততই বাড়ছে পানির স্বল্পতা। পানি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একদিন যুদ্ধই লেগে যেতে পারে - এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। নীল, তাইগ্রিস ও ফোরাতের মতো নদীগুলো সবসময় যে পানিতে টইটম্বুর থাকে তা নয়। বরং চাষাবাদের জন্য বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল অনেক এলাকায় প্রায়ই খরার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।


পানিসঙ্কট নিরসনে উদ্ভাবিত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি - লোনাপানিকে লবণমুক্ত করা, ভূগর্ভস্থ নদী আবিষ্কার কিংবা জীবাশ্ম জল আহরণপদ্ধতি। এগুলো সাময়িক সমাধান দিতে পারে।


কিন্তু তারপর? তারপর কী হবে, কেউ জানে না। (বিদেশী সাময়িকী অবলম্বনে)


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com