ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকের ছোট একটা দেশ ভুটান। একটা সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুর জন্যই প্রতিবেশি দেশ ভারতের উপর নির্ভর ছিলো। বিশ্ব রাজনীতিতে কেউ বিশেষ পাত্তা দিতো না এই দেশকে। চীন তো যখন তখন গায়ের জোরে নিজেদের ঘাঁটি বসাতো দেশটিতে।
সেই গুরুত্বহীন দেশটিই এখন বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ। একথা সাধারণ কোনো মানুষের নয় এমন দাবি করছে স্বয়ং জাতিসংঘ। তাদের বাছাই করা সুখী দেশের তালিকায় সবার উপরে নাম আছে ভুটানের। কিন্তু বিশ্বের বড় বড় দেশ থাকতে ভুটান কেন? উন্নত দেশগুলির মতো অর্থ, প্রযুক্তি, সামরিক বাহিনী, লোকবল কিছুই তো নেই ভুটানের। দেশবাসীর জীবনযাত্রার মানও একদম সাধারণ। তাহলে?
কারণটা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। মনে হবে এই ছোট গুরুত্বহীন অনুন্নত দেশের বাসিন্দা এবং সরকারের কাছ থেকে বিশ্বের প্রতিটি দেশের শিক্ষা নেয়া উচিৎ।
মহামারী থেকে নিরাপদ
ভুটানের মাথার উপর রয়েছে করোনার আঁতুরঘর চীন, আর নীচে বিশ্বের প্রথম সারির করোনাভাইরাস বহনকারী রাষ্ট্র ভারত। মাঝখানে থেকেও ছোট দেশ ভুটান কিন্তু করোনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিয়েছে। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে সেখান ভুটানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে মাত্র একজন। রোগীর সংখ্যাও হাতে গোনা। দেশের সরকার এবং মানুষ যেভাবে সন্তর্পণে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে রোগ প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাতে সেটাই স্বাভাবিক। গরিব দেশ হয়েও তাই বিশ্বের বড় বড় শক্তিশালী দেশকে মহামারি প্রতিরোধের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিয়েছে ভুটান।
দূষণমুক্ত দেশ
বিশ্বের একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ হওয়ার তকমা পেয়েছে ভুটান। হিমালয়ের বুকে অবস্থানকারী এই দেশের ৭০ শতাংশ অরণ্য। তাই বিষাক্ত গ্যাস পরিবেশে মেশার আগেই গায়েব হয়ে যায়। দেশবাসী এবং সরকার উভয়েই পরিবেশ সচেতন। তারা জানেন যে নিজের থেকেও বেশি যদি প্রকৃতির যত্ন নেয়া হয় তাহলে প্রকৃতিও পাল্টা তাদের যত্ন নেবে।
সবুজের দেশ
হিমালয় প্রদেশের শেষ রাজতন্ত্রের দেশ ভুটানের চারদিকে শুধুই সবুজ গাছপালা। দেশটির রাজধানী থিম্পু আধুনিক শহর হলেও সবুজ প্রকৃতি দিয়ে ঘেরা। থিম্পু ছাড়াও পুনাখা, ওয়াঙ্গুড়ে সবুজ পাহাড়ে মোড়া। চারদিকে ঘাসের জমি, ধানের ক্ষেত, নদী এবং হ্রদ। প্রকৃতির এই শোভা ভুটানবাসীকে যেমনই সুখী রাখে তেমনই রাখে সুস্থ।
ট্র্যাফিক জ্যাম বিহীন দেশ
লকডাউনের সময়টা বাদ দিলে বাকি সময় তো শহরজুড়ে রাস্তায় এক দণ্ডও শান্তি মেলে না। ট্র্যাফিক জ্যাম, গাড়ির হর্ণের বিকট শব্দ, কালো বিষাক্ত ধোঁয়া, অধৈর্য লোকজনের চিৎকার চেঁচামিচি যেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ। কিন্তু ভুটানে গেলে এই দৃশ্য খুঁজে পাবেন না। এদেশের ট্র্যাফিক নিয়ম খুব কঠোর। নাগরিকরাও সচেতন। রাস্তায় কোনো ট্র্যাফিক সিগন্যাল নেই। ট্র্যাফিক পুলিশরাই গাড়ি ও রাস্তার সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই ট্র্যাফিক পুলিশের নির্দেশ বা জেবরা ক্রসিং এলে গাড়ি আপনা থেকেই থামিয়ে দেবেন গাড়ির চালক। জেবরা ক্রসিং দিয়ে নিশ্চিন্তে রাস্তা পারাপার করবেন পথচারী। গাড়ি ওভারটেকের কোনো বালাই নেই। চলন্ত গাড়িকে হাত দেখিয়ে রাস্তা পারাপারের বদ অভ্যাসও নেই ভুটানবাসীর। এখানে এতটাই নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলা হয় যে সেখানে কাউকে কখনো ট্র্যাফিক জ্যামের মুখে পড়তে হয় না। এরকম দেশে বসবাস করার আনন্দই আলাদা।
উৎসবের দেশ
দেশের বেশিরভাগ মানুষই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছর ভর তাদের উৎসব চলে। শেচুস (Tshechus) ভুটানিদের জাতীয় উৎসব। তিব্বতি চন্দ্রমাসের দশম দিনে ভুটানের প্রতিটি জেলায় জাঁকজমক করে এই উৎসব পালিত হয়। শেচুস ছাড়াও স্থানীয় আদিবাসীদের পর্ব তো আছেই। রয়েছে খাদ্য উৎসব, বিজয়ের উৎসব, স্থানীয় দেবদেবীর পুজো। সব মিলিয়ে সারা বছরই আনন্দে থাকেন ভুটানিরা। সেদেশে যে কোনো সময়ই বেড়াতে যান না কেন যে কোনো ভুটানি উৎসবের দেখা পাবেন।
আধ্যাত্মিক আবহ
দেশের প্রধান ধর্ম বৌদ্ধ হওয়ায় দেশজুড়ে শান্তির বার্তাবরণ থাকাটাই স্বাভাবিক। ভুটানের বৌদ্ধ মঠগুলিতে প্রবেশ করলে মন এমনিই শান্ত হয়ে যায়। ভুটানে এখনো পুরোনো রীতি মেনেই বৌদ্ধধর্ম পালন হয়। আধ্যাত্মিক ভাবনা গোটা দেশকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সেই আচ্ছন্নতায় মিলেমিশে যান পর্যটকরাও। ফলে ভুটানিদের মতো সেদেশে বসবাসের সময় পর্যটকরাও বেজায় সুখবোধ করেন।
খাবার দাবার
ভুটানের জিভে জল আনা খাবারের খবর খুব কম লোকেই রাখেন। এখানকার যে কোনো মাংসের পদ একবার খেলে কেউ ভুলতে পারবেন না। আর বলাবাহুল্য সুস্বাদু খাবার খেলে মনে আনন্দ এমনিই থাকে। ভুটানের জাতীয় খাবার এমা দাতশি। এটি ভুটানি লাল এবং সাদা চাল দিয়ে তৈরি হয়। মুরগির মাংসের জাসুয়া মারু, থুকপা, বাথুপ, গরুর দুধের তৈরি পনির ডাটসি, নুডলস, মোমো, থুকপা এগুলো খুবই সুস্বাদু খাবার।
বিবার্তা/অনামিকা/এনকে
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]