শিরোনাম
প্রাণীরাও ব্যবহার করে হরেক রকম দেহঘড়ি
প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০১৬, ১৩:২৬
প্রাণীরাও ব্যবহার করে হরেক রকম দেহঘড়ি
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

সামুদ্রিক প্রাণীরা সময় বোঝার জন্য দেহঘড়ি ছাড়াও আরও বিভিন্ন রকম ঘড়ি ব্যবহার করে। প্রাণীজগতের সব সদস্য, হোক সে ক্ষুদ্র ছত্রাক থেকে শুরু করে পশু এমনকি মানুষ সবাই দেহ ঘড়ি বা দেহের অন্তর্নিহিত যে সময় রক্ষক তার সাহায্যে দেহের সব কাজকর্ম, আহার, নিদ্রা ও নিদ্রা হতে জেগে ওঠাকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু প্রাণী, এমনকি মানুষও একাধিক ঘড়ির সাহায্যে দেহের স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনা করে।


অধিকাংশ সামুদ্রিক প্রাণী ২৪ ঘণ্টায় সময়কে ভাগ করে না এমন কিছু চক্রের সাহায্যে সময় হিসাব করে। দিনের মাঝে একাধিক বার জোয়ারভাটার চক্র তাদের শিকার করা বা খাদ্য সংগ্রহ করা বা অন্যান্য কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, আবার মাসিক চক্রগুলো ৩০ দিনের জন্য তাদের প্রজনন ক্রিয়াকেও প্রভাবিত করে।


অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার নিউরোবায়োলজিস্ট, ক্রিস্টিন ট্রেসমার-রেইবল বলেন, বহু বহু বছর আগে প্রাচীন গ্রীসে জেলেরা লক্ষ্য করেছে, সমুদ্রের শামুক ঝিনুক চাঁদের সাথে মিল রেখে তাদের ওজন হ্রাসবৃদ্ধি ঘটায়। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘পূর্ণিমা অমাবস্যার চক্রের সাথে এদের প্রজনন অঙ্গের আকারে বৃদ্ধি বা হ্রাস ঘটে।’


বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সামুদ্রিক প্রাণীর সব সদস্য সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্ল্যাঙ্কটন হতে বৃহৎ আকারের কাঁকড়া ও অন্যান্য জলজ প্রাণী এই চক্র মেনে চলে। তবে প্রাণীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট ব্যখ্যা করতে গিয়ে এই চক্র বা দেহ ঘড়ির গুরুত্ব যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, তা হলো এই দৈহিক ঘড়ি কি অনেকগুলো ঘড়ির সমষ্টি নাকি কেবল একটি ঘড়িরই পরিবর্তিত রূপ। সহলেখক ট্রেসমার-রেইবল বলেন, ‘আর তখনই আমরা এ ব্যাপারে জানতে পারি’।


ট্রেসমার-রেইবল এবং ইংল্যান্ডের লিচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের কারালাম্বোস কিরাকুসহ আরেকটি দল উভয়ই দুটি ভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী যারা একাধিক চক্রের মাধ্যমে দৈহিক কাজকর্ম পরিচালনা করে তার নিদর্শন পান।


চন্দ্রচক্রের রহস্য ট্রেসমার-রেইবলের দল আবিষ্কার করেন, একপ্রকার সামুদ্রিক কেঁচো বা র‍্যাগ ওয়ার্ম যার বৈজ্ঞানিক নাম Platynereis dumerilii, একটি দেহ ঘড়ি ও চন্দ্র ঘড়ির সমন্বয়ে তাদের সময়ের হিসাব রাখে। এরা অমাবস্যার শুরুতে প্রজননক্রিয়া সম্পন্ন করে এবং নতুন প্রজন্মের জন্ম দেয় এবং এরা আবার আবার এক মাস পর প্রজনন করতে সক্ষম হয়। র‍্যাগওয়ার্মের পরিপূর্ণতা লাভের এই একমাস ব্যাপি চক্র ও কিছু র‍্যাগওয়ার্মের এই চক্রপূর্ণ করার ব্যর্থতা থেকেই গবেষকরা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হন যে দেহচন্দ্র ঘড়ি ও দেহঘড়ি সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন বিষয়।


কিন্তু এক অনাকাঙ্ক্ষিত মোড়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য জানা যায় তা হল র‍্যাগওয়ার্মের দেহচন্দ্রঘড়ির জন্য দায়ী জিন তাদের দেহ ঘড়ির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। শুধু তাই নয়, এদের চলাফেরা বা সামুদ্রিক গাছ বা পাথরের উপর হাঁটাও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। দেহচন্দ্র ঘড়ির আনবিক কর্মকাণ্ড এখনো রহস্যময় থাকায় ট্রেসমার-রেইবল নিশ্চিত নন, কীভাবে এটা ঘটছে।


কিরাকু ও তাঁর দল সামুদ্রিক ক্রাস্টাসিয়া প্রাণী ইউরিডাইস পালচেরা যা একপ্রকারের পোকা- এরমাঝে একই সাথে দুই প্রকারের ঘড়ির উপস্থিতি টের পান। দেহঘড়ির পাশাপাশি অন্য ঘড়িটি ছিল সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে সম্পর্কিত। তবে এদের দেহের ঘড়ি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।


কিরাকু এক গবেষণার রিপোর্টে ব্যাখ্যা করেন, ইউরিডাইস পালচেরা সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে মিল রেখে খাদ্য সংগ্রহ করে, জোয়ারের সময় সাঁতরে সাঁতরে এগিয়ে যায় আর ভাটার সময় আবার তীরের দিকে ফিরে আসে। কাজেই এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় এরা ঢেউ এর সাথে বা দেহ চন্দ্র ঘড়ির সাথে মিল রেখে কাজ করছে কিন্তু সেই ঘড়ি কীভাবে কাজ করছে তা নিয়ে বিতর্কও আছে।


কিরাকু আরও বলেন, কিছু গবেষকদের মতে সামুদ্রিক ঢেউ বা জোয়ার ভাঁটার সাথে যে ঘড়ি কাজ করে এই প্রাণীদের মধ্যে সেটি আসলে দুটি দেহঘড়ির অসামঞ্জস্য হয়ে চলারই ফল। আবার অন্যরা মনে করতেন জোয়ারভাটা ঘড়ি ও দেহঘড়ি দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বাধীন প্রক্রিয়া এবং এভাবেই তা বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছে।


ই. পালচেরার জিনে যে প্রোটিন দেহঘড়ির দায়িত্বে থাকে তা নষ্ট করা হলেও দুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘড়ি কাজ করতে পারে এবং তখন তার সাতাঁর কাটা নির্ভর করে জোয়ারভাটার উপর, কিরাকু এবং তাঁর দল এ বিষয়টি প্রমাণ করে দেখান।


‘দেখে মনে হয় এরাই এদের নিজেদের অস্তিত্ব’, কিরাকু যোগ করে বলেন, ‘তারা আরও কিছু উপাদান ব্যবহার করতে পারে তবে এটা নিশ্চিত যে দেহঘড়ি কোনভাবেই জোয়ারভাটার সাথে সম্পর্কিত ঘড়ির উপর কোন প্রভাব ফেলে না।’


টেসমার-রেইবলের মত ই. পালচেরার ঘড়িগুলো একে অপরের সাথে সম্পর্কিত নয়। কিরাকুর মতে ‘আমি অবশ্যই এমনটি দেখে একটু একটি অবাক হয়েছি। আমি ভেবেছিলাম এদের মাঝে আরও মজবুত কোন সংযোগ থাকবেই।’


এমনকি উনি ওনার কয়েকজন সহ-লেখকদের সাথে যেমন মলিকিউলার বায়োলজির জন্য ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজে অবস্থিত এমআরসি ল্যাবরেটরিতে মাইকেল হেসটিংসের সাথে এ ব্যাপারে বাজিও ধরেছিলেন। ‘এবং আমি সেই বাজি হেরেছি’ হাসতে হাসতে কিরাকু বলেন।


একটি ঘড়ির ভেতর কিরাকু এবং টেসমার-রেইবল উভয়ই পরিকল্পনা করেন নিজ নিজ বিষয়ের ঘড়ির ওপর আরও গভীরভাবে পড়াশোনা ও জানার লক্ষ্যে কাজ করবেন। এক বাজিতে কিরাকু ই. পালচেরায় একই প্রোটিন কি দুটি ঘড়িরই কাজ কে প্রভাবিত করে কি না এটা জানার জন্য কিছু পরীক্ষা করেন।


তিনি বলেন ‘আমরা কিছু ঘড়ির জিনকে নষ্ট করে দিচ্ছি এটা দেখার জন্য যে তাদের মধ্যে কিছু জিন কি পূনরায় ব্যবহৃত হয় কিনা’। কিরাকু বলেন, একই রকম ঘড়ির জিন বিভিন্ন প্রজাতিতে বিভিন্ন রূপে দেখা যেতে পারে। কাজেই এ ধরনের গবেষণা ক্রাস্টাশিয়ান প্রাণী ছাড়াও অন্যদের উপরও প্রভাব বিস্তার করবে।


টেসমার-রেইবল আরও বলেন, পৃথিবীর প্রাণীদের মধ্যে বহু ধরনের ঘড়ি থাকতে পারে। ‘ইদুরের কিছু জিন এর গতিকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত এগিয়ে নিতে পারে যা তার দেহ ঘড়ির সময়ের সমান’ তিনি বলেন। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের ঘুম ও পূর্ণিমা ও অমাবস্যার চক্র তথা চন্দ্রচক্রের সাথে সম্পর্কিত, আবার আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু হরমোন মানুষের দেহের চক্র মাসিক অথবা অর্ধ মাসিক করতে সাহায্য করে।


টেসমার-রেইবল বলেন, ‘কেন ইঁদুরের জিন প্রতি ১২ ঘণ্টা পর পর তার চক্র কে পরিবর্তন করে? কেন মানুষের প্রতি মাস অন্তর একটি সময় পরিমাপকের প্রয়োজন হয়? এগুলো এমন কিছু প্রশ্ন যা নিঃসন্দেহে জ্ঞানের সীমাকে আরও সমৃদ্ধ করবে।’


বিবার্তা/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com