শিরোনাম
কলকাতায় মুসলিম মেয়েরা মাতলো ফুটবলে
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০১৭, ০৮:১৫
কলকাতায় মুসলিম মেয়েরা মাতলো ফুটবলে
স্পোর্টস ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

বিশ্বের অনেক দেশেই মুসলিম নারীরা ফুটবল খেলেন, বিশ্বকাপ সহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশও নেন। তাই মুসলিম নারীদের ফুটবল খেলাটা নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু যখন স্কুল কলেজের কিছু ছাত্রী আর মুসলিম পরিবারের গৃহবধূ প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল দখলের চেষ্টায় মাঠে দৌড়চ্ছেন, বা কর্ণার কিক করছেন, অথবা ঝাঁপিয়ে পড়ে গোল আটকাচ্ছেন, সেটা ভারতের কলকাতার রক্ষণশীল মুসলিম এলাকা রাজাবাজারের মানুষের কাছে আলোচনার বিষয়। শনিবার দুটি মেয়েদের ফুটবল দলের ম্যাচ ছিল ওই এলাকায়। ওই ফুটবল ম্যাচে দলের গোল রক্ষা করছিলেন তহসিনা বানু। দুবছরের একটি ছেলে রয়েছে তাঁর।


রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের এই গৃহবধূ বলেন, ‘পাড়ায় ছেলেদের ফুটবল খেলতে দেখলে গায়ে বল লেগে যাওয়ার ভয়ে দূরে সরে যেতাম একটা সময়ে। কিন্তু তারপরে একটা সুযোগ এল আমাদের নিজেদের খেলার। তার আগে কোনও দিন বলে পা ছোঁয়াইনি। প্রথম শটটা মেরে মনে হয়েছিল পরেরটা আরেকটু জোরে মারতে হবে। এই করেই এনার্জি বাড়তে থাকল। আর এখন গোলকীপিং করি, তাই সবসময়েই গায়ে বল লাগছে!’


তহসিনাকে অবশ্য তাঁর মা ছাত্র-ছাত্রীদের সামরিক শিক্ষা দেয়ার যে ব্যবস্থা ভারতে আছে, সেই ন্যাশানাল ক্যাডেট কোরে পাঠিয়েছিলেন।


তাহসিনা বলেন, ‘তার পেছনেও একটা কারণ ছিল। আমি খুব মোটা ছিলাম ছোটবেলায়। মা মনে করত এরকম মোটা মেয়ের বিয়ে হবে না। তাই শারীরিক কসরৎ করলে যদি একটু রোগা হই, যাতে বিয়ে হয় ঠিকমতো। মানে এনসিসি করতে যেতে দেয়াটাও ছিল বিয়ে যাতে হয়, সেইজন্য।’


কলেজ ছাত্রী নেহা খাতুন বলেন, ছোটবেলায় স্কুলের ছেলে বন্ধুরা ফুটবল খেলত, দেখতে ভাল লাগত। কিন্তু তারা শিক্ষকদের কাছে ফুটবল খেলার অনুমতি চেয়েও পাননি। বলা হয়েছিল, ওটা ছেলেদের খেলা।


আরেক ছাত্রী ফরহিন নাজকে ছোট থেকেই বাড়ির বাইরে খেলাধুলো করতে যাওয়ায় বাধা দিয়েছে পরিবার। কিন্তু হঠাৎ করেই নিজের পাড়াতেই ফুটবল প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়ে গেছেন তিনি। তার ভাষায়, ‘ছোট থেকে বাইরে বাইরে আমাদের মেয়েদের খেলতে যেতে দেয়া হত না। একটা সময়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য হই। সেখানকার সদস্যদের দেখভালের দায়িত্ব ছিল আমার মতো আরও কয়েকজনের ওপরে। সেখানে বাচ্চা ছেলেরা যখন ফুটবল খেলত, সেটা দেখেই একটা সময়ে আমারও ইচ্ছা হয় ফুটবল খেলার। মনে হয়েছিল ছেলেরা যেটা পারে, সেটা মেয়েরা কেন পারবে না?’


গোড়ার দিকে পাড়ার লোকে বাড়ি এসে বলে যেত যে ফুটবল খেলাটা মোটেই মেয়েদের মতো আচার আচরণ নয়। বাড়িতে অনেক চেষ্টা করে বোঝাতে হয়েছে ফারহিনকে। আরেক ছাত্রী মেহজবিন নাজ বাড়িতে মিথ্যা কথা বলে খেলতে যেতেন, কিন্তু একদিন বাবার কাছে ধরা পড়ে যান।


তিনি বলেন, ‘বাড়িতে মিথ্যা কথা বলে যেতাম যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বাচ্চাদের দেখভাল করতে যাচ্ছি বলে। বাবা একদিন ফুটবল খেলতে দেখে ফেলেন। বাড়ি ফিরে প্রচণ্ড বকা খেতে হয়েছিল। খেলাধুলো তো একদম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মুম্বইতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর একটা সম্মেলন আর ফুটবল ম্যাচ ছিল। সেখানেও বাড়িতে মিথ্যা কথা বলেই যেতে হয়েছিল। ফিরে এসে অবশ্য বাবাকে জানিয়েছিলাম যে আমি ম্যাচ খেলেছি, আর হাফপ্যান্ট পড়ে মাঠে নেমেছিলাম। বাবা তারপরে হঠাৎই জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেমন হল ম্যাচ! বুঝলাম বাবা মেনে নিল আমার খেলাটা।’


রাজাবাজারের এই ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন শাহিনা জাভেদ বলেন পাড়া, পরিবার - সব দিক থেকেই বহু চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে তাঁদের মাঠে নামতে হয়েছে।


তাঁর কথায়, ‘আমাদের সমাজটা এমন, এখানে ছেলেরা সবকিছু খেলতে পারে, কিন্তু মেয়েদের কোনও বাইরের খেলা খেলতে দেয়া হয় না। রান্নাবাটি, কিৎকিৎ এসব খেলতাম আমরা। একটা সুযোগ এসেছিল মেয়েদের ফুটবল খেলার। অনেক চেষ্টা করে সাতজন মেয়েকে তৈরী করেছিলাম। সেই শুরু। তবে বহু বাধা এসেছে। সমাজ তো নানা কথা বলেই, অনেকের পরিবারও বাধা দেয়। কটূক্তি শুনতে হয়। মাঠ পাই না খেলার। ছেলেদের খেলা হয়ে যাওয়ার পরে সন্ধ্যেবেলায় আমরা প্র্যাকটিস করতে পারি। এই ম্যাচের জন্যও অনেকগুলো মাঠ চেয়েও পাইনি।’


তবে এখন অনেক ছেলেই তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন, কী করে ঠিকমতো খেলতে হবে, কী করে গোল করা যায়, সেসব ছেলেরাই বলে দেয় অনেক সময়ে।


‘আমরা ওদের কাছ থেকে শিখি, কিন্তু এটাও বলে দিই যে ফুটবলটা আমাদের কাছে শুধু খেলা নয়, বিনোদন নয়। ফুটবল আমাদের কাছে স্বাধীনতা’ বলছিলেন শাহিনা জাভেদ।


মেয়ের টীম মাঠে নামবে। তাই শাহিনার বাবা মুহম্মদ জাভেদ খুব ব্যস্ত দুপুর থেকেই। জানতে চেয়েছিলাম, মেয়ে ফুটবল খেলতে মাঠে নামছে- মেনে নিয়েছেন এটা?


জাভেদের জবাব ছিল, ‘আসলে আমাদের মুসলিম সমাজটা এমনই যে মেয়েদের খেলাধুলো, বাইরে বেরনো এসব নিয়ে খুব আপত্তি। আমার মেয়ে অনেকদিন থেকেই সমাজসেবার সঙ্গে যুক্ত। বাধা দিইনি আমরা। পাড়ার লোকদের সঙ্গেও আমাকে লড়তে হয় যে ছেলেরা যদি পারে, অন্য মেয়েরা খেলতে পারে, তাহলে মুসলিম মেয়েদের খেলতে আপত্তি কোথায়? তবে একই সঙ্গে সমাজটাকেও সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়, তাই ওরা নিকাব পড়েই খেলে।’


শনিবারের ম্যাচে রাজাবাজারের রোশনী টীমের বিপরীতে যারা খেলতে নেমেছিল - তারাও স্বাভাবিকভাবেই মেয়ে- এবং সকলেই মেডিক্যাল ছাত্রী- মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে এই ম্যাচ খেলার জন্যই তারা এসেছিল কলকাতায়।


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com