শিরোনাম
ছেলেধরা গুজব আর গণপিটুনির ঘটনায় জনমনে বাড়াচ্ছে আতঙ্ক
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০১৯, ১৮:২৯
ছেলেধরা গুজব আর গণপিটুনির ঘটনায় জনমনে বাড়াচ্ছে আতঙ্ক
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

সম্প্রতি তাছলিমা বেগম রেনু নামের এক নিঃসঙ্গ মাকে ‘শিশুচোর’ সন্দেহে গণপিটুনি দেয়া হয়। ঢাকার একটি স্কুলে ভর্তিসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সহিংস জনতার আক্রমণের শিকার হয়ে মারা যান তিনি। গতকাল সারা দেশে শিশুচোর সন্দেহে তিনজন গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন।


মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩৬ জন গণপিটুনিতে মারা গেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা প্রয়োজন- এমন গুজবে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সৃষ্ট আতঙ্কের কারণে গণপিটুনির হার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।


ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে গতকাল তিনজন নিহত আর অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন। হতাহতদের মধ্যে চারজনই নারী। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) নওগাঁয় ছেলেধরা সন্দেহে ছয়জনকে গণপিটুনি দেয় উত্তেজিত জনতা।


তাদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। গত কয়েকদিনে দেশটিতে ছেলেধরা সন্দেহে এমন বেশ কয়েকটি গণপিটুনির খবর সংবাদের শিরোনামে উঠে আসে।


পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, যারা নিহত হয়েছেন, তাদের কেউ কেউ ওই এলাকায় অনেক দিন ধরে বসবাস করতেন।


কয়েকজন মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। কিন্তু অভিভাবকদের সন্দেহ হওয়ায়, তাদেরও বেধড়ক পেটানো হয় বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ।


পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে, এমন গুজবের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয়েছে ছেলেধরা আতঙ্ক। এরইমধ্যে রাজধানীর বাড্ডা, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে তিনজন। বিভিন্ন স্থানে গণধোলাইয়ের পর পুলিশে দেয়া হয়েছে অন্তত চারজনকে।


শনিবার (২০ জুলাই) সকালে রাজধানীর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক নারীকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হলেও বাঁচানো যায়নি তাকে।


নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে এক শিশুকে ধরে নেয়ার চেষ্টা করছিলো ওই যুবক। ওই শিক্ষার্থীর চিৎকার করলে তাকে নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় দেয় ওই যুবক। কিন্তু সন্দেহ হলে তাকে আটক করে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। একই এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে শারমিন বেগম রেশমা নামে এক নারীকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয়রা।


এদিকে কেরানীগঞ্জে ছেলেধরা সন্দেহে দুই যুবককে গণপিটুনি দেয় এলাকাবাসী। এতে একজন নিহত হয়। অন্যজনকে গুরুতর আহতবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। শনিবার (২০ জুলাই) সকাল সাড়ে আটটার দিকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন হযরতপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।


স্থানীয়রা জানান, শনিবার সকালে ওই দুই যুবক গ্রামে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। তারা শিশুদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। এতে তাদের উপর সন্দেহ হলে এলাকাবাসী ধরে গণপিটুনি দেয়।


গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও কুষ্টিয়া ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ছেলে ধরা সন্দেহে গণধোলাই দেয়া হয় চারজনকে। এদিকে গুজবে কান দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের শামিল বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশ প্রশাসন। এছাড়া, গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মারাকে বড় ধরনের অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে এগুলো থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। শনিবার (২০ জুলাই) বিকেলে এক বার্তায় এ নির্দেশনা দেয়া হয়।


পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, পদ্মা সেতু নির্মাণে মাথা লাগবে- একটি মহল এমন গুজব ছড়ানোর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকজন গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন।


পুলিশ সদর দপ্তর আরো জানায়, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি একটি ফৌজদারি অপরাধ। আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। গণপিটুনির ঘটনা তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।


নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুবাস চন্দ্র সাহা জানান, ঘটনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে বিভিন্ন স্থানে ছেলে ধরা গুজবে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরাও। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ চেয়েছেন তারা।


গাজীপুরে ছেলেধরা সন্দেহে নারীকে গণপিটুনি


গাজীপুরে ছেলেধরা সন্দেহে এক নারীকে গণপিটুনি দিয়েছে স্থানীয়রা। শনিবার সকালে গাজীপুর মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই নারীকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।



টাঙ্গাইলে গণপিটুনির শিকার ভ্যানচালক ছেলেধরা ছিলেন না, গ্রেফতার ৬


টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় ছেলেধরা গুজবকে কেন্দ্র করে মিনু মিয়া (৩০) নামের এক ভ্যানচালককে অমানবিক নির্যাতনের ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।


গ্রেফতারকৃতরা হলেন- কালিহাতী উপজেলার নাগা চৌধুরীবাড়ি গ্রামের মৃত তরিকুল আলম সিদ্দিকীর ছেলে মাইনুল হক হিটু (৩৭), নাগা গ্রামের সন্তোষ চন্দ্র মালুর ছেলে প্রভাত চন্দ্র মালু (১৯), একই গ্রামের আনোয়ার হোসেন খানের ছেলে শিশির আহম্মেদ খান (৩২), মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে মিজানুর রহমান তালুকদার (৪৭), আনোয়ার হোসেন খানের ছেলে ওমর (৩২) এবং পালিমা গ্রামের ফজলু মিয়ার ছেলে আলামিন ইসলাম (১৯)।


এদিকে, প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান তাসলিমা বেগম রেনু (৪০)। তাই মা হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে শত মানুষের ভিড়ে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর-ফরিদগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কে দাঁড়িয়েছে চার বছরের অবুঝ শিশু তাসনিম তুবাও।


মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে রেনু হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে রায়পুরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করছে স্থানীয় সর্বস্তরের মানুষ। এসময় সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মা হত্যার বিচার চেয়ে তুবা চারদিকে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে।


আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে স্রেফ সন্দেহের বশে ঘটছে এই গণপিটুনির ঘটনা। কয়েকজন নিরীহ ব্যক্তি গণপিটুনিতে নিহত হওয়ায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন।


বিষয়টি নিয়ে দৃশ্যত উদ্বিগ্ন পুলিশও। ছেলেধরার গুজব বন্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব এবং ব্লগগুলো নজরদারির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ছেলেধরা-সংক্রান্ত বিভ্রান্তিকর পোস্ট দিলে বা শেয়ার করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।


পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-অপারেশন্স) সাঈদ তারিকুল হাসান সারাদেশের পুলিশের ইউনিটকে এই বার্তা পাঠান।


বার্তায় উল্লেখ করা হয়, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ব্লগ এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছেলেধরা-সংক্রান্ত বিভ্রান্তিমূলক পোস্টে মন্তব্য বা গুজব ছড়ানোর পোস্টে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে।


বার্তায় মোট চারটি উপায়ে ছেলেধরার গুজব ও গণপিটুনি প্রতিরোধে পুলিশের ইউনিটগুলোকে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়।


এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি, স্কুলে অভিভাবক ও গভর্নিং বডির সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়, ছুটির পর অভিভাবকরা যাতে শিক্ষার্থীকে নিয়ে যায় সে বিষয়ে নিশ্চিত করার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা, প্রতিটি স্কুলের ক্যাম্পাসের সামনে ও বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, মেট্রোপলিটন ও জেলা শহরের বস্তিতে নজরদারি বৃদ্ধির নির্দেশ দেয়া হয়েছে।


এছাড়া বার্তায় গুজব বন্ধে জনসম্পৃক্ততামূলক কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গুজববিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি, এলাকায় মাইকিং-লিফলেট বিতরণ, মসজিদের ইমামদের ছেলেধরা গুজববিরোধী আলোচনার নির্দেশনা।


এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের কোন ইউনিট কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে ফ্যাক্সের মাধ্যমে জানাতে বলা হয়েছে।


ছেলেধরার গুজব আর গণপিটুনির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহেল রানা বিবার্তাকে বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষী মহল এধরণের কাজগুলো করে থাকে। আর তারা সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়গুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করে, তখন মানুষও বিভ্রান্ত হয়ে ভুল করে বসে। মূলত মানুষের বিশ্বাসগত ভুল আর যাচাই-বাচাইয়ের অনাগ্রহের কারণে এধরণের কাজগুলো হচ্ছে।


সাম্প্রতিক ইস্যুকে টেনে অধ্যাপক সোহেল রানা বলেন, বর্তমানে স্বার্থান্বেষী মহল মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে যে, পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে। তাদের এ অপপ্রচারে সাধারণ মানুষও বিভ্রান্তিতে পড়েছে। অবস্থাটা এমন হয়েছে যে, ভালো মানুষকে ভালোভাবে না জেনে গণপিটুনি দেয়া হচ্ছে।


এর থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক সোহেল রানা বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। তাছাড়া সাধারণ মানুষকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। এছাড়া সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। গণমাধ্যমগুলোকে এবিষয়ে ফোকাস করতে হবে।


ছেলেধরা গুজবে সরকারের কঠোর হুঁশিয়ারি

সরকার কোনো সন্দেহজনক ঘটনা অথবা গুজবের ভিত্তিতে কোনো নিরীহ মানুষকে হত্যা করার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, এ ধরনের ঘটনা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ছেলেধরা সন্দেহে সাম্প্রতিক কয়েকটি হতাহতের ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে সোমবার সতর্কতা উচ্চারণ করে একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে।


বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একটি স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়ে ছেলেধরা সন্দেহে নিরীহ মানুষ পিটিয়ে হতাহত করা সংক্রান্ত খবরের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যেকোনো ধরনের গুজব ছড়ানো ও আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী এবং গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ। কোনো বিষয়ে কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে নিজের হাতে আইন তুলে না নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ৯৯৯ নম্বরে কল করে পুলিশের সহায়তা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।


গণপিটুনির কারণ যা-ই হোক কেন, শরিয়তে তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য


শরিয়ত মানুষের বিচারের ভার মানুষের হাতে তুলে দেয়নি। কোনো মানুষ অপরাধ করলে তার বিচার রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থার মাধ্যমেই হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘জাকাত, হদ (শরিয়ত নির্ধারিত শাস্তি), ফাই (যুদ্ধলব্ধ এক প্রকার সম্পদ) ও জুমা সুলতানের (রাষ্ট্রের) দায়িত্ব।’ (আহকামুল কোরআন লিল জাসসাস, পৃষ্ঠা ১৩১)


ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই কিসাস (প্রাণদণ্ড) বাস্তবায়ন করবে- এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে কোনো মতভিন্নতা নেই।’ (তাফসিরে কুরতুবি : ২/২৪৫)


শরিয়ত অপরাধের শাস্তি বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে দিয়ে শেষ করেনি; এর সঙ্গে সন্দেহাতীতভাবে তা প্রমাণিত হওয়ারও শর্ত দিয়েছে। সুতরাং কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে অভিযোগ পেলে তা প্রমাণের পূর্বে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, রাষ্ট্রও তাকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার রাখে না। ইসলামী দণ্ডবিধির একটি মূলনীতি হলো, ‘সন্দেহ হদ বা শাস্তি রহিত করে।’ (কাওয়াইদুল ফিকহ)


এমনকি ব্যভিচারসংক্রান্ত এক হাদিসে রাসুল (সা.) অকাট্যভাবে প্রমাণের পূর্বে অপরাধীর ব্যাপারে কুধারণা পোষণ করতেও নিষেধ করেছেন। সেখানে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মানুষকে প্রহার করা, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা কিভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে?


গণপিটুনিতে কেউ নিহত হলে তা ইসলামী দণ্ডবিধি মোতাবেক হত্যা হিসেবেই বিবেচিত হবে এবং এর সঙ্গে জড়িত সবাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত হবে —সংখ্যায় তারা যতই হোক না কেন। তবে হ্যাঁ, সবার শাস্তি এক হবে না, আবার সব হত্যার বিধানও এক হবে না। যদি গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্য হত্যা হয় তাহলে সবাই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হবে, যদি না তারা নিহতের আত্মীয়দের সঙ্গে মৃত্যুপণের বিনিময়ে আপস করতে সক্ষম হয়।


ইসলাম মানুষকে মানুষের জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বলেছে। বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্ভ্রম পরস্পরের জন্য হারাম; আজকের দিনের মতো, তোমাদের শহরের (মক্কা) মতো, তোমাদের এই মাসের (জিলহজ) মতো। অতি শীঘ্রই তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। সুতরাং আমার পরে তোমরা কুফরির দিকে ফিরে যেয়ো না যে তোমরা পরস্পরের ঘাড়ে আঘাত করবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৭০২)


সুতরাং যদি কোথাও গণপিটুনির মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাহলে মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো গুজবে কান না দিয়ে ধৈর্য ধারণ করা এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া, যেন তার উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা যায়।


পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘যদি তোমরা তাদের শাস্তি দিতে চাও তবে তাদেরকে সেই পরিমাণ শাস্তি দাও, যে শাস্তি তারা তোমাদেরকে দিয়েছে। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, তবে তা ধৈর্যধারণকারীদের জন্য কল্যাণকর হবে।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৬) ভেবে দেখতে হবে, অপরাধ প্রমাণের পূর্বেই যদি ব্যক্তিকে আঘাত করা হয়, তাকে হত্যা করা হয়, তাহলে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা কিভাবে সম্ভব? সেটা কি বাড়াবাড়ি ও অবিচারের শামিল হবে না?


বিবার্তা/রাসেল/শারমিন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com