জানুয়ারি ২০১৮ থেকে ৭ জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত ৫৩৭ জন শিশু (১২ বছরের কম) ধর্ষণ, ৫৩ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। যাদের মধ্যে ২০৮ জনকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়।
এটা তো গেল শিশুধর্ষণের পরিসংখ্যান, প্রাপ্ত বয়স্ক ধর্ষণের শিকার হয় প্রতি বছর কম-বেশি ১০ হাজারের বেশি নারী, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৯৪ বছর। এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি খুন হয়ে যায়। পরিসংখ্যানটি ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’ ও ‘বাংলাদেশ নারী অধিকার সংস্থা’র সর্বশেষ রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়েছে।
পরিসংখ্যানের খাতা কলম রেখে চারদিকে নজর দিলেই বুঝা যায় যে ধর্ষণের সংখ্যাটা মোটেই এটা নয় বরং এর চেয়ে ঢের বেশি। বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় কতজন নারী নিরব ধর্ষণের শিকার হয় তার খবর কেবল সেই নারীর লুকানো কান্নাই জানে। আর যে সকল নারী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হয় কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকেন তারা কি আদৌ বেঁচে থাকে? তাদের মানসিক মৃত্যু তো ধর্ষণের প্রথম থাবায়ই নিশ্চিত হয়ে যায়। ধর্ষিতার পরিবারের কথা ভাবুন তো। পুরো পরিবার কি একটি জীবন্ত লাশে পরিণত হয়ে যায় না ?
জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশসহ ছয়টি এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশের পুরুষদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন স্বীকার করেছেন নিজের স্ত্রী নয় এমন নারীকে তারা কোনো এক সময় ধর্ষণ করেছেন। স্ত্রীর ইচ্ছের বাইরে তার ওপর বলাৎকার চালিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন এমন পুরুষের সংখ্যা এক চতুর্থাংশ। বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে নারীকে ধর্ষণ করার ঘটনা সবচেয়ে কম ঘটেছে বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায়।
ব্রিটিশ মেডিকেল সাময়িকী ‘ল্যানসেটে’ দুটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে, যাতে চমকে দেয়ার মতো এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি দল বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও পাপুয়া নিউগিনির ১০ হাজারেরও বেশি পুরুষের ওপর সম্প্রতি দুটি সমীক্ষা চালায়।
গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, ধর্ষণের কারণ সম্পর্কে উত্তরদাতাদের মধ্যে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ (৭৩%) জানিয়েছেন, এটাতে তাদের অধিকার রয়েছে বলে মনে করেন। অর্ধেকের বেশি (৫৯%) বলছেন, শারীরিক আনন্দের জন্যই তারা জোর করে যৌনসঙ্গম করেছেন। আর এক-তৃতীয়াংশের (৩৮%) বেশি উত্তরদাতা বলেছেন, নারীকে শাস্তি দেয়ার জন্যেই তারা এ কাজ করেছেন।
‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ নামের সংগঠনটি বাংলাদেশের ১৪টি দৈনিক পত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে বলছে, ২০১৮ সালে ১০৫০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এই সংখ্যা কিছুটা কম হলেও ধর্ষণ, নির্যাতনের ধরণ ছিলো নির্মম ও নিষ্ঠুর।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা নতুন নয়, তবে সম্প্রতি সময়ে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও। শিশু ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল। আর বরাবরের মতোই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে দায়ী করেছিল অনেকে।
অনেকে দোষ দিচ্ছেন খোদ নারীকে বা নারীদের পোশাক পরিচ্ছদকে। তাদের কথাই যদি ঠিক ধরে নেয়া যায় তবে গাইবান্ধার চার বছরের, চাপাইনবাবগঞ্জের ছয় বছরের সেই শিশুর কী পোশাকে কোনো ত্রুটি ছিল? কিংবা টাঙ্গাইলের ৯৪ বছরের বৃদ্ধার পোশাকে বা চালচলনে কি এমন দোষ ছিল যে তাদের নির্মমভাবে ধর্ষণের শিকার হতে হল? এসব ধর্ষণ আসলে ধর্ষকের মানসিক বিকার গ্রস্থতাকেই সামনে নিয়ে আসে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত নয় বছরের এক দীর্ঘ গবেষণার পরে আঁতকে উঠার মতো তথ্য প্রকাশ করে। বাংলাদেশ ও ভারতে প্রতি বছর কম বেশি ৩৬% বেড়েছে শিশু ধর্ষণ, ৪৪% বেড়েছে নারী ধর্ষণ আর ধর্ষণের পরে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে ৮২ শতাংশকে। অন্যদিকে এসব ধর্ষণের পরে আইনের আশ্রয় নিতে দেখা গেছে মাত্র ২৩ শতাংশকে, যাদের মধ্যে মাত্র ছয় শতাংশ নারী ন্যায্য বিচার পেয়েছেন, বাকিরা বিচার তো পাননি বরং উল্টো হয়রানীর শিকার হয়েছেন।
ইউরোপীয় দেশগুলোতে ১৫ বছরের হবার আগেই ধর্ষণের শিকার হয় শতকরা ৩৩ জন নারী, আর যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যাটা ৬৪ জনে গিয়ে ঠেকেছে। স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার নিজের স্বামীর কাছেও নিরাপদ নয় স্বল্পোন্নত দেশের নারীরা। ভারতের শতকরা ৫৬ জন আর বাংলাদেশের শতকরা ৩৮ জন নারী এমন নীরব ধর্ষণের শিকার হয়।
এ ধরনের ঘটনার একটি সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব পড়ে নারীর মনের উপর, দেখা দিতে পারে মানসিক সমস্যাও। আর এ ধরনের ধর্ষণের ফলে অধিকাংশ সময় অসুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারে নারী বলে জানিয়েছেন ফ্রান্সের একদল চিকিৎসক।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) সারা দেশ থেকে গড়ে প্রতিদিনই গড়ে চার-পাঁচজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে আসছেন। আর প্রতিমাসে দেড় থেকে দুই শতাধিক ধর্ষিতাকে চিকিৎসা দিচ্ছেন তারা। এই হিসেব হচ্ছে যারা ওসিসিতে চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের।
এছাড়া দেশের অন্যান্য হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রে যারা চিকিৎসা নেন তাদের হিসেব নেই ওসিসির কাছে। চিকিৎসার বাইরে যারা থাকেন, সামাজিক লজ্জায় যারা ঘটনা প্রকাশ করেন না তাদের হিসেব পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ওসিসির মতে, সাধারণত এর শিকার ১৮-১৯ বছর বয়সি মেয়েরা।
আর খোদ রাজধানী ঢাকার চিত্রটি কিছুটা হলেও পাওয়া যায় পুলিশের হিসাব থেকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৫৫৪টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রাস্তা থেকে অপহরণ করে গাড়ির মধ্যে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মামলা রয়েছে অন্তত ৫০ ভাগ।
আর জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসেব অনুযায়ী, ২০১১ সালে সারা দেশে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়। তবে অপহরণ করে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা সম্প্রতি সময়ে অনেক বেড়েছে।
ধর্ষণের কারণ ও এর কারণে নারীর মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফারজানা আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, ধর্ষণ একটি মানসিক ও সামাজিক ব্যাধি এবং পাশাপাশি এটি ধর্ষিতাকেও মানসিক ব্যাধির দিকে ঠেলে দেয়। ধর্ষণের পরে অনেকেই আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়, অনেকে হয়ত জীবনে কখনো সেই ক্ষত ভুলতে পারেন না।
তিনি বলেন, আর ধর্ষকের কথা যদি বলতে হয়, একজন ধর্ষক কিন্তু জন্ম থেকেই ধর্ষক নয়। তার ছোট থেকে বেড়ে উঠার পারিপার্শ্বিক পরিবেশটা তাকে ধর্ষক করে গড়ে তুলে। আবার অনেকেই হয়ত তার চারপাশে এ ধরনের কার্যক্রম হরহামেশা দেখেই দিনযাপন করছেন। তার মধ্যেও কিন্তু একটি ধর্ষণের সুপ্ত ইচ্ছা জেগে উঠে সে সময়। এদেরকে আমরা বলি ‘পটেনশিয়াল রেপিস্ট’। এরা হয়ত ভাল মানুষের মতো আমাদের চারপাশে আছে, কিন্তু সুযোগ পেলেই এরাই ধর্ষণ করতে দ্বিধা করবে না। এরা আরো ভয়ঙ্কর।
ধর্ষণের বিচার নিয়ে ড. ফারজানা বলেন, আসলে ধর্ষণের বিচারের ফলাফল খুব কমই আমরা দেখতে পাই। একজন মানুষ যখন দেখবে গত ১০-১৫ বছরে ধর্ষণ করার ফলে ৫০ জন মানুষের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে বা যারা ধর্ষণ করেছে তাদের সবাইকে দ্রুততম সময়তে গ্রেফতার করা হয়েছে বা কেউ আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হয়ে যেতে পারেনি, তখন কিন্তু ওই মানুষটার পক্ষে আর ধর্ষণ করা সম্ভব হবে না, এটা নিয়ে সে চিন্তা করতেও দুবার ভাববেন। কিন্তু অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মনে হয় ধর্ষণ বা হত্যার জন্য যেন কোনো বিচারই নেই। বিচারের দীর্ঘ সূত্রিতা এবং শেষ পর্যন্ত ধর্ষক যখন জামিনে বের হয়ে সবার চোখের সামনে ঘুরে বেড়ান, ঠিক সেই মুহূর্তে আরো ১০ জন মানুষের মনে ধর্ষণের চিন্তা জেগে উঠে। যেহেতু বিচারের নমুনা তাদের চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান এই বিষয়ে বিবার্তাকে বলেন, আমরা অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিতে দেরি করি না। ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়ায় যা করতে হয় সেটা আমরা দ্রুততার সাথেই করি। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীর জন্য ঢাকা মহানগর এলাকায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারও আছে। এই সেন্টারটি পুলিশের নারী সদস্যদের দিয়েই পরিচালিত হয়। তদন্ত কর্মকর্তারাও নারী। আর থানাগুলোতে নারী ও শিশু-বিষয়ক মামলা দেখার জন্য আলাদা নারী পুলিশ কর্মকর্তা আছেন। তবে নারীদের আরো সাহসী হয়ে এগিয়ে আসতে হবে, অভিযোগ করতে হবে।
বিবার্তা/আদনান/উজ্জ্বল/জাকিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]