পুরান ঢাকার সকালটা যেন একটু বেশিই সকাল, ঠিক সকাল না বলে ভোর বললেও ভুল হবে না। আর সেই কাকডাকা ভোরে পুরান ঢাকার অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী জনসমাগমের জায়গা হচ্ছে বংশাল পুকুর। শুনতে খটকা লাগলেও শত বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে পুরান ঢাকার বংশাল ও এর আশে পাশের এলাকায়।
জনশ্রুতি আছে অতীতে এই পুকুর পারে এলাকার বিচার-শালিস বসত হরহামেশা। এখন তেমনটা না হলেও পুকুরে গোসল করে সকাল শুরু করাটা যেন রীতিমত একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ছে এখানে। এটি স্থানীয়ভাবে ‘জনতার পুকুর’ হিসেবেও পরিচিত।
১৭৮ বছরের পুরানো পুকুরটির আয়তন ছয় বিঘা। ১৮৪০ সালের দিকে এটি খনন করা হয়। এলাকাবাসীর পানি সমস্যা সমাধানে বংশালের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও জমিদার হাজী বদরুদ্দীন ভুট্টো এটি খনন করেন। প্রায় ৪০০ ফুট লম্বা ও ২৫০ ফুট চওড়া এ পুকুরটির গভীরতা প্রায় ২০ ফুট। পুকুরটির চারদিকে পাকা বেষ্টনী ও রাস্তা।
এই ভুট্টো হাজীই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে শিল্প আন্দোলন, সমাজসেবা, জনহিতকর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অনেক কীর্তি রেখে গেছেন। চামড়ার ব্যবসা করে অঢেল সম্পদের মালিক হলেও তার বেশিরভাগই ব্যয় করেছেন জনহিতকর কাজে। এক সময় ঢাকায় চামড়া ব্যবসার নিয়ন্ত্রক ছিলেন। ঢাকার নবাব খাজা আলীমুল্লাহ ও খাজা আব্দুল গনির চামড়ার ব্যবসা কিনে নিয়েছিলেন। তখন তার অংশীদার ছিলেন ইংরেজ ব্যবসায়ী লেজারস। তার সঙ্গে ভুট্টো হাজী পাট ব্যবসাও করেছেন।
মুহাম্মদ আব্দুর রহমানের লেখা ‘মর্দি মুজাহিদ হাজী বদরুদ্দনী’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, নবাব আব্দুল গনি বাংলার লাটকে বুড়িগঙ্গায় এক জাহাজে সংবর্ধনা দেয়ার সময় ভুট্টো হাজী মেহমান হিসেবে সেখানে যান। নদীর তীরেই বাকল্যান্ড বাঁধের জন্য টাকা তোলা হলে ভুট্টো হাজী ১০ হাজার টাকা দান করেন। তখন বড়লাট মুগ্ধ হয়ে তার সম্পর্কে জানতে চান। জানতে পারেন, এই ভুট্টো হাজীই ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে জড়িত এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে। কিন্তু তার ব্যবহার ও দানশীলতায় মুগ্ধ হয়ে বড়লাট সব অভিযোগ তুলে নেন!
রাস্তার পাশ ধরে পুকুরের চারদিকে সারিবদ্ধভাবে লাগানো আছে নারিকেল গাছসহ অন্যান্য গাছ। গাছ ও স্বচ্ছ পানির কারণে পুকুরের চারদিকেই বিরাজ করছে ঠাণ্ডা আমেজ। এই পুকুরের রয়েছে দুইটি বাঁধানো ঘাট। এখানে বসানো হয়েছে টোল ব্যবস্থা। প্রতিবার গোসলের জন্য প্রত্যেককে দিতে হয় তিন টাকা। এই পুকুরের স্বচ্ছ পানি দেখে মুগ্ধ হতে হয়। পুকুরের চারপাশে সবুজের সমারোহ। গাছের ছায়ায় নৈসর্গিক এক সৌন্দর্য। নগরবাসীর মন ভালো করে দেয়ার মতো এক পুকুর। এই পুকুরের ধারে রয়েছে ব্যায়ামের ব্যবস্থাও।
পুকুরকেন্দ্রিক যত কর্মকাণ্ড
কর্মসংস্থান : এই পুকুর ঘিরে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ডজনখানেক লোকের। প্রতিদিন প্রায় নয়জন পাহারাদার পুকুরটি পাহারা দেন। পানি পরিষ্কার করার জন্যও আছেন কয়েকজন।
সাঁতার শেখা : তিন টাকায় বংশাল পুকুরে গোসল ও সাঁতার সেখার সুযোগ যা রাজধানীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। বংশাল এলাকার অধিকাংশ মানুষেরই সাঁতার শেখার মূলকেন্দ্র এ পুকুর। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকেও মানুষ আসে সাঁতার শিখতে।
ব্যয়াম চর্চা : হাঁটা আর সাঁতার কাটা থেকে ভালো ব্যয়াম আর কি হতে পারে? পুকুর পাড়ে সারি সারি গাছ আর চারপার এতো সুন্দর করে বাঁধানো হয়েছে যে, আপনি যতোই অলস হন না কেন একটু হেঁটে আসবেনই। আর এলাকাবাসী তো নিয়মিত হাঁটে এবং সাঁতার কাটে।
ফ্রি গোসল : মহল্লার প্রতিটি মানুষের জন্য গোসল ফ্রি। তাদের জন্য একটি বিশেষ ঘাট রয়েছে। তবে সবার জন্য হাত, মুখ ধোয়া ও অজু ফ্রি। এসবের জন্য কোনো টাকা লাগে না।
মসজিদের খরচ : পুকুর থেকে প্রাপ্ত আয় প্রথমে যায় মসজিদে। এরপর প্রয়োজন হলে এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নে সে টাকা ব্যবহার করা হয়।
রূপচর্চা : ঢাকার ক্লোরিনযুক্ত পানি দিয়ে মাথা ধুয়ে যাদের চুল ঝরে যাচ্ছে তাদের জন্য এই পুকুর আশীর্বাদ।
মাছ চাষ : পঞ্চায়েত কমিটি প্রতি বছরই মাছ চাষ করে এই পুকুরে। এ বছর প্রায় ৫ লাখ টাকার মাছ ছাড়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিটির নেতারা।
মাছ ধরার প্রতিযোগিতা : কয়েকদিন পর পর মাছ ধরার প্রতিযোগিতা হয়। হাজার হাজার টাকা দিয়ে মানুষ টিকিট কেটে মাছ ধরতে আসে। এই আয় থেকে প্রাপ্ত টাকা চলে যায় মানুষের কল্যাণে।
সামাজিক ঐক্য : পুকুরটিকে ঘিরে এলাকার মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে ঐক্য। এলাকার শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই সবাইকে চেনে এই পুকুরের কল্যাণেই।
বিশুদ্ধ অক্সিজেন : পুকুরের পাড় ঘিরে আছে অসংখ্য নারিকেলসহ বিভিন্ন ফলের গাছ। এই গাছগুলো যে শুধু ফলই দেয় তা নয়। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে গাছগুলো এলাকাবাসীর জন্য বিশুদ্ধ অক্সিজেনেরও যোগান দিচ্ছে।
জোছনা উপভোগ : চাঁদের আলো যদি নারিকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখতে চান, তবে এ শহরে বংশাল পুকুর তার জন্য সবচেয়ে সঠিক জায়গা। একবার জোছনা রাতে যান, তারপর আপনি একমত হবেনই।
বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরণ : ঢাকায় বিনামূল্যে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া সম্ভব নয়, এমনটা যারা বিশ্বাস করেন তাদের সেই ভুল ভাঙবে বংশাল পঞ্চায়েত কমিটির কার্যকলাপ দেখে। তারা পুকুরের প্রাপ্ত আয় দিয়ে নিজস্ব পানির পাম্প থেকে বাংশাল এলাকার মানুষজনকে বিনামূল্যে খাবার পানিও সরবারহ করে।
ঋণ বিতরণ : পুকুরের গোসল থেকে প্রাপ্ত টাকা পঞ্চায়েতের মানুষদের ঋণ দেয়া হয়। যা দিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকেই।
অসহায়, গরীবদের পাশে : পুকুরের আয়ে কত অসহায় মানুষের যে সুচিকিৎসা নিশ্চিত হয়েছে, তার তালিকাটাও বিশাল। এ রকম একটা তালিকা দেখলেও আপনি একটা পুকুর খনন করতে চাইবেন।
বিয়ে : অসচ্ছ্বল এলাকাবাসীর বিয়েতে এই পুকুরের আয় থেকে অনুদানও যায়।
আগুন নেভানো : আশেপাশে কোথাও আগুন লাগলে বংশাল পুকুর ফায়ার সার্ভিসের ভরসাস্থল।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন সাইফুল ইসলাম, থাকেন বাড্ডা এলাকায়। সময় পেলেই চলে আসেন এখানে গোসল করতে। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আমার কাজের সুবাদে আমি এতটুকু বলতে পারি পুকুর বা জলাশয় পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুরান ঢাকার মত ঘনবসতি এলাকায় এধরনের একটি পুকুর যেন আশীর্বাদ। তবে পুকুরটাকে আরও একটু সংস্কার করা দরকার, প্রচারণা দরকার।
বংশাল পঞ্চায়েতের সদস্য হাজি গোলাম মউলা বিবার্তাকে বলেন, এই পুকুর এখন হাজার হাজার মানুষের বিনোদনের স্থান। দল বেঁধে যুবক, শিশু-কিশোর-বৃদ্ধরা এখানে এসে প্রাণ জুড়ায়। সন্ধ্যায় পুকুরের পাড়ে আড্ডা চলে। আশপাশের বাড়িগুলোও তৈরি করা হয়েছে পুকুরের দিকে মুখ করে। যেন সবাই এই পুকুরের শীতল ছোঁয়া চায়। মূলত, শত বছর ধরে এই পুকুর আমাদের সেবাই করে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা পুকুরের সেবা তেমন একটা করতে পারি না।
পুকুর নিয়ে সামনে কোন পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করি পুকুর রক্ষণাবেক্ষণ করার। গত বছরেরও প্রায় দুই লাখ টাকার কাজ করেছি, এবারও সামনের শীতে পুকুরের পানি পরিবর্তন করা হবে, মাছ ছাড়া হবে। তবে ঐতিহাসিক একটি জায়গা হিসেবে যদি সরকার এটার প্রতি একটু সুনজর দিত তাহলে আরও অনেক ভাল হত।
ভুট্টো হাজীর বংশধরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার লোক এই পুকুরে গোসল করছে। পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যের পঞ্চায়েত কমিটির মাধ্যমে এই পুকুরটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।
বিবার্তা/আদনান/উজ্জ্বল/শারমিন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]