শিরোনাম
প্রশাসন ছিল পঞ্চায়েত নির্ভর: পঞ্চায়েতের সেকাল-একাল (পর্ব-২)
প্রকাশ : ২২ জুন ২০১৯, ০৯:২৪
প্রশাসন ছিল পঞ্চায়েত নির্ভর: পঞ্চায়েতের সেকাল-একাল (পর্ব-২)
আদনান সৌখিন
প্রিন্ট অ-অ+

পঞ্চায়েত প্রথা পুরোপুরি চালু না থাকলেও এখনো পুরানো ঢাকার অলিগলিতে মিশে আছে কিছু কিছু সফল পঞ্চায়েত সরদারের নাম।


তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, আফিরুদ্দিন ছিলেন কমলাপুরের সরদার, ইলিয়াছ ছিলেন রায়সাহেব বাজারের সরদার, আহসান উল্লাহ লোহারপুল সরদার, জুম্মন রহমতগঞ্জের সরদার, মির্জা আবদুল কাদের ইসলামপুরে এলাকার সরদার, আবদুল গণি লালবাগের সরদার, খলিল হাজারীবাগের সরদার, মাজেদ নাজিরাবাজারের সরদার ও মাওলা বখ্শ্ সূত্রাপুর-ফরাশগঞ্জ মহল্লার সরদার।


১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ করার পর এই প্রথাটি প্রায় ভেঙে যায়। সালিশ-বিচারের দায়িত্ব পড়ে ওয়ার্ড কমিশনারদের ওপর। তারপরও যে পঞ্চায়েতের সরদার প্রথা বিলোপ হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। মানুষ ন্যায়বিচারের জন্য সরদারদের কাছে যেতই।


এখনো পুরান ঢাকার কোথাও কোথাও পঞ্চায়েত প্রথা দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, পুরানো ঢাকার সূত্রাপুর-কাগজীটোলা পঞ্চায়েত, ফরাশগঞ্জ-লক্ষ্মীবাজার পঞ্চায়েত, গোয়ালঘাট পঞ্চায়েত, দক্ষিণ মৈসুন্ডি পঞ্চায়েত, ফরিদাবাদ পঞ্চায়েত, ধোলাইপাড় পঞ্চায়েত, কসাইটুলী পঞ্চায়েত, খাজে দেওয়ান পঞ্চায়েত, কলতাবাজার পঞ্চায়েত, রায়সাহেব বাজার পঞ্চায়েত ও বংশাল পঞ্চায়েত।



এই পঞ্চায়েত কমিটিগুলো আগের মতো শালিস-বিচার না করলেও তারা বিভিন্ন সামাজিক ও সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে। গরিব-দুঃস্থ মেয়েদের বিয়েতে সাহায্য করা, মৃত ব্যক্তির পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করা, ইফতারি বিতরণ করা, ফ্রি চিকিৎসা, মহল্লার দুঃস্থ লোকদের জন্য কোরবানি দেয়ার মতো সামাজিক সেবামূলক কাজ এসব পঞ্চায়েত কমিটির প্রধান বিষয়।


লালবাগের খাজে দেওয়ান পঞ্চায়েতের সহ-সভাপতি আব্দুর রহমান মাসুম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফ জাহান বিবার্তাকে বলেন, ঢাকার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্যই আমাদের এই পঞ্চায়েত। সপ্তাহে একবার বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া এবং ওষুধ বিতরণ করা হয়। আমাদের রয়েছে ২৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি।


নারিন্দার বসুরবাজার লেন পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি হাজী সাহাবুদ্দিন আহম্মদ এবং সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক ফরহাদ বিবার্তাকে বলেন, এখন পঞ্চায়েত বিচার-সালিশের চাইতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বেশি সম্পৃক্ত থাকে।


একটা সময় পঞ্চায়েত প্রথার ওপর নির্ভরশীল ছিল প্রশাসনিক ব্যবস্থা। পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকে আদালতের জুরি বোর্ডে পঞ্চায়েত প্রধানদের জন্য চেয়ার ছিল। কোর্টের বিচারে তাদের মূল্যায়ন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। নগর জাদুঘরে সরদারদের ছবি পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। জাতীয় জাদুঘরেও স্থান নেই তাদের।


সামাজিক অনুষ্ঠানের তদারকি ছাড়াও পঞ্চায়েতের একটি প্রধান কাজ ছিল মহল্লার সবধরনের বিবাদ মীমাংসা করা। মহল্লার বিবাদ দেখা দিলে সালিশের জন্য যে কোনো পক্ষ পঞ্চায়েত বৈঠকের জন্য অনুরোধ জানাতে পারত। তবে এর খরচ আহবানকারী পক্ষকে বহন করতে হত। খরচ ছিল পান তামাকের, অন্যকিছু নয়।



সাধারণত এ ধরনের বৈঠক ডাকা হত বৃহস্পতিবার রাতে। বাদী-বিবাদী ছাড়াও মহল্লার যে কেউ যোগ দিতে পারতেন মজলিস বা বৈঠকে। লায়েক বিরাদার এবং সরদার প্রশ্ন করতেন বাদী-বিবাদীকে। তারপর দেয়া হতো রায়। দুপক্ষকেই মেনে নিতে হতো পঞ্চায়েতের রায়। এ রায়ের প্রতি কোনো রকম অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা যেত না। তবে ইচ্ছে করলে অন্য পঞ্চায়েতের সরদারদের নিয়ে গঠিত ‘বিচারালয়ে’ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যেত।


৬৮ বছর বয়সী হাজি রুস্তম আলি নামক আলুবাজারের বাবসায়ী জানান, আমরা তখন অনেক ছোট, সে সময় থেকেই পঞ্চায়েত প্রভাবে কমতে শুরু করেছে। স্বাধীনতার পরে সেটা আরো কমে যায়, প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। তবে আমার বাবা, দাদাদের মুখে অনেক শুনেছি পঞ্চায়েতের কথা, কি জৌলুসই না ছিল সে সময় পঞ্চায়েতের।


একটা রীতি ছিল যে, সেই সময় সরদাররা কোনো বিবাদ মিটাতে না পারলে যেতেন কাজী জহুরুল হক, কাজী আলাউদ্দীন, হাকিম হাবিবুর রহমান, সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর এবং কাজী ইসমাইলের কাছে। এরা ছিলেন ঢাকার সে আমলের গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব। আমাকে এসব বলেছেন আমার দাদা হাজী মুসাদ্দেক আলী।


ধারণা করা হয়, নওয়াব সলিমুল্লাহর পর পঞ্চায়েতের ওপর নওয়াব পরিবারের আধিপত্য কমে যায়। পরে নওয়াব পরিবারের বিকল্প হিসেবে উপরিউক্ত ব্যক্তিবর্গ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এরা জমিদার ছিলেন না বটে, কিন্তু ছিলেন খানদানি বংশের, সচ্ছল ও শিক্ষিত। এককথায় ‘আহসান মঞ্জিলের’ নতুন যুগের প্রতিনিধি। সমাজে এদের আধিপত্য তখন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়।


বিবার্তা/আদনান/উজ্জ্বল/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com