শিরোনাম
শিশুশ্রমের শেষ কোথায় ?
প্রকাশ : ১২ জুন ২০১৯, ১৫:২৭
শিশুশ্রমের শেষ কোথায় ?
আদনান সৌখিন
প্রিন্ট অ-অ+

বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস আজ ১২ জুন (বুধবার)। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। তবে বন্ধ নেই শিশুশ্রম।


১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস। শিশুদের অধিকার রক্ষায় জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হলেও রাজধানীসহ সারা দেশে এ দিনেও বন্ধ ছিল না শিশুশ্রম।


রাজধানীর অনেক রোডে যাত্রীবাহী বিভিন্ন গাড়ীতে হেলপার, কলকারখানা, গার্মেন্ট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, বাসাবাড়ি, চায়ের দোকান ও ইটভাটায় চলছে শিশু শ্রমিক নিয়োগ। যে বয়সে তাদের হাতে থাকার কথা পাঠ্যবই আর খেলার পুতুল, অভাবের তাড়নায় সেখানে তাদের কোমল হাত হয়ে উঠছে উপার্জনের পাথেয়।


নাবিস্কো বলতে পারছে না। বলছে ‘নাবিতকো উঠেন, নাবিতকো উঠেন’। এভাবেই রাজধানীর ফার্মগেট থেকে নাবিস্কোগামী যাত্রীদের লেগুনায় যেতে ডাকছে ৭ বছরের ছোট্ট শিশু বরকত। মুখে এখনো কথা ফোটেনি ঠিকভাবে। এরই মাঝে লেগুনার হেলপার হিসেবে নেমেছে উপার্জনে।



শুধু ফার্মগেট নয়, রাজধানীর যত জায়গায় লেগুনা চলে তার প্রায় সব জায়গাতেই হেল্পার বা ড্রাইভার হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে এসব ছোট শিশুদের। ছোট্ট শিশুটির হাতের এক থাপ্পড়েই থেমে যাচ্ছে লেগুনা, আবার চলছে তার ইশারাতেই। যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে গম্ভীর গলায়। ছোট হাতে টাকা গুণলেও হিসাবে কোনো গরমিল নেই।


শিশু বরকতের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সে তার মায়ের সঙ্গে নাবিস্কোতে একটি ভাড়া বাসায় থাকে। তার মা বাসা বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। তিন বোনের একমাত্র ভাই বরকত। তাই দায়িত্বটাও একটু বেশি। বরকত সবার ছোট। প্রতিদিন কাজ করে ১৪০ থেকে ২০০ টাকা ‍আয় হয় তার। পুরোটাই সে তুলে দেয় মায়ের হাতে।


স্কুলের কথা মনে পড়ে না? এমন প্রশ্ন করতেই উদাস হয়ে যায় বরকত। জানায় স্কুল ও সহপাঠীদের প্রতি ভালো লাগার কথা। কিন্তু অভাবের সংসারে যেখানে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের যোগান দিতেই উঠে নাভিশ্বাস, সেখানে তার লেখাপড়া বিলাসিতারই নামান্তর। বরকতের মনে তার বাবার কোনো স্মৃতি নেই। পিতার স্নেহ-ভালোবাসা বঞ্চিত শিশুটি মায়ের কাছ থেকে শুনেছে, সে যখন অনেক ছোট তখনই তার বাবা অন্য একজনকে বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে যায়।



শুধু বরকত নয় বরকতের মতো এমন অনেক শিশু রয়েছে যারা প্রতিনিয়ত নিজের ও পরিবারের জন্য দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের যোগান দিতে সংগ্রাম করে চলেছে। চলন্ত লেগুনায় এসব শিশুরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় লেগুনা থেকে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারাত্মক আহতও হয় তারা।


পুরান ঢাকার একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করে শিশু রহিমা। বয়স ৮ বছর। ছোট্ট হাতে বড় হাঁড়ি পরিষ্কার করতে সিদ্ধহস্ত সে। রান্নাঘরের থালাবাসন পরিষ্কার করার জায়গাটি তার নাগালের বাইরে, তাই বড় টুলের উপরে দাঁড়িয়ে কাজ করে সে। হাসিমুখে করে চলেছে সব কাজ। নেই কোনো অভিযোগ। বাসার ছোট্ট শিশুটি তার অনেক প্রিয়। অবসর কাটে তার সঙ্গে খেলাধুলা করে।


কমলাপুর রেল স্টেশনে দেখা মেলা শিশু জনির। অন্য শিশু শ্রমিকদের মতো তাকেও দেখা যায় বোঝা বহন করতে। তার পিছু নিয়ে বোঝামুক্ত হবার পরই কথা হয় তার সঙ্গে। শোনায় তার জীবনের গল্প।



জনির মা নেই। সৎ মায়ের সংসারে সে বড্ড বেশি বোঝা হয়ে গিয়েছিল। কারণে অকারণে মারধরে অতিষ্ট হয়ে একদিন চাঁদপুর থেকে চেপে বসে লঞ্চে। শুরু হয় অজানার পথে যাত্রা। লঞ্চ এসে ঢাকায় পৌঁছলে একদিন কাটে তার সদরঘাটে। পরদিন ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় কমলাপুরে। সেখানে দেখতে পায় তার মতো অনেক শিশু। তাদের দেখে কিছুটা সাহস পায় সে। কথা বলে জানতে পারে এরা সবাই কমলাপুর রেল স্টেশনে কুলি মজুরের কাজ করে। এদের বেশিরভাগেরই বাবা নেই। কারও কারও মা আছে। এরপর থেকে তার ঠিকানা হয় কমলাপুর। সারদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে পায় ১০০ থেকে ১২০ টাকা। তাই দিয়েই চলে যায় জীবন।


তবে কমলাপুরের পেশাদার কুলিদের জীবিকায় ভাগ বসানোতে তাদের হাতে মারধোরের শিকারও হতে হয় তাদের। রাতে ঘুমানোর নেই কোনো জায়গা, প্লাটফরমে ঘুমালে রাতে এসে পুলিশে উঠিয়ে দেয়। এভাবেই চলছে তার জীবন।


বাংলাদেশে এরকম ঝুঁকিপূর্ণ থেকে কম ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় অনেক শিশু নিয়েজিত রয়েছে। যে বয়সে স্কুল ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাবার কথা সে বয়সেই কচি কাঁধে উঠেছে সংসারের বোঝা। এসব শিশুদের চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। তবুও বিরাম নেই কাজের।



বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৪ লাখ। এর মধ্যে ১২ লাখ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত।


শ্রম আইন ২০১২ অনুসারে ১৪ বছরের নিচে কাউকে শ্রমে নিয়োজিত করা যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা পুরোই ভিন্ন। ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী শ্রমজীবী শিশুদের দেখা যায় সব স্থানে। বর্তমানে এদের সংখ্যা এতটাই বেশি যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা শিশুশ্রম নিরোধের পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরোধের বিষয়ে প্রচার চালাচ্ছে।


বিবার্তা/আদনান/উজ্জ্বল/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com