শিরোনাম
নতুন পথ ধরেছে টেকনাফের ইয়াবা কারবারীরা!
প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০১৮, ২০:৫৫
নতুন পথ ধরেছে টেকনাফের ইয়াবা কারবারীরা!
খলিলুর রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

ইয়াবা ব্যবসার নিরাপদ রাস্তা ছিল টেকনাফ। তবে সম্প্রতি ওই এলাকায় ৫টি ক্যাম্প স্থাপন করেছে র‌্যাব, যেখানে আছে ডগ স্কোয়াড। কিন্তু তারপরও থেমে নেই ইয়াবা কারবারীরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা নতুন রাস্তা দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসছে ইয়াবা।


র‌্যাবের অনুসন্ধানে এমন তথ্যই বেরিয়ে এসেছে।


র‌্যাব জানায়, মিয়ানমার হতে ইয়াবা প্রথমে আসতো টেকনাফে। সেখান থেকে বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়ানো হতো। ইয়াবার এ বিস্তার বন্ধ করতে গত ২৫ জুলাই থেকে টেকনাফে র‌্যাবের অতিরিক্ত ৫টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে ডগ স্কোয়াড। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইয়াবা সরবরাহ দূরূহ হয়ে ওঠে। তাই ইয়াবা কারবারীরা নতুন রাস্তায় ইয়াবা সরবরাহ করতে পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুসারে সমুদ্রপথে মহেশখালী হয়ে চকরিয়া দিয়ে ইয়াবা চালানের নতুন রুট তৈরী করে ওরা। ওই রুট ধরে ইয়াবার বড় একটি চালান নিয়ে ঢাকায় আসে চার যুবক। গতকাল র‌্যাবের অভিযানে ঢাকার পূর্বাচল থেকে তাদের পাকড়াও এবং একটি ক্যাভার্ড ভ্যান ও একটি ট্রাকও জব্দ করা হয়। পরে গাড়ি দুটি থেকে ২ লক্ষাধিক ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়।


র‌্যাব জানায়, ইয়াবা পাচারের কৌশল হিসেবে আসন্ন ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত লবণ বহনকারী পরিবহনগুলোকে টার্গেট করে ইয়াবা কারবারীরা। পরিকল্পনামত কক্সবাজার থেকে লবণবোঝাই দুটি গাড়ি ইয়াবা ট্যাবলেটের বড় চালান নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।


এ সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাবের গোয়েন্দা দল গাড়ি দুটি শনাক্ত করে এবং তাদের গতিবিধি অনুসরণ করে। এক পর্যায়ে নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল এলাকায় গাড়ি দুটি পৌঁছলে অভিযান শুরু করে র‌্যাব। এ সময় মানিক মিয়া (২৭), আরিফ (২২), মাসুম মিয়া (৪০) ও আব্দুল খালেককে (২৮) আটক করা হয়। তাদের মধ্যে মানিক ও মাসুম চালক, বাকি দু’জন হেলপার।


র‌্যাব জানায়, আটককৃতদের দেয়া তথ্যমতে কাভার্ড ভ্যানের সামনের অংশের গোপন প্রকোষ্ঠে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে রাখা ১ লাখ ৯৬ হাজার পিস এবং ট্রাকের অতিরিক্ত চাকার ভেতর থেকে ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ সর্বমোট ২ লাখ ৬ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত মাদকদ্রব্যের বাজার মূল্য প্রায় ৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। তবে দুটি পরিবহনেই লবণবোঝাই করা ছিল বলে জানায় র‌্যাব।



ইয়াবা নিয়ে যেভাবে ঢাকার পথে যাত্রা



র‌্যাব জানায়, আটকের পর তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ সময় তারা নতুন কৌশলে ইয়াবা ব্যবসা এবং এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আরো অনেকের নাম প্রকাশ করেছে। তাদের বিশাল একটি চক্র রয়েছে। ওই চক্রের সদস্য আটক চারজন। তারা ২৮ জুলাই টেকনাফ থেকে লবণ লোড করে যাত্রার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে। অবশেষে গত ৩ আগস্ট টেকনাফ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। টেকনাফের রফিক নামক এক মাদক দালালের পরিকল্পনা অনুযায়ী চকরিয়াতে গাড়ি মেরামতের অজুহাতে পূর্বনির্ধারিত একটি ওয়ার্কশপে যাত্রা বিরতি করে। এ সময় ওই ওয়ার্কশপে মাসুমের তত্ত্বাবধানে কাভার্ড ভ্যানে গোপন প্রকোষ্ঠটি তৈরী করা হয়। পরে ওর ভেতর ১ লাখ ৯৬ হাজার পিস ইয়াবা ঢোকানো হয়। এ ছাড়া মাসুম তার ট্রাকের অতিরিক্ত চাকার ভিতরে ১০ হাজার পিস ইয়াবা লুকিয়ে রাখে।



র‌্যাব আরো জানায়, ইয়াবাগুলো সমুদ্রপথে মিয়ানমার থেকে মহেশখালী হয়ে চকরিয়া পর্যন্ত নিয়ে আসে অন্য একটি চক্র। টেকনাফের রফিক নামের এক দালাল ওই চক্রের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখে এবং সে চকরিয়ার ওই ওয়াকর্শপে ইয়াবাগুলো পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে। ট্রাকচালক মাসুম ইয়াবাগুলো চকরিয়ার চক্রের কাছ থেকে গ্রহণ করে। ইয়াবাগুলো মাসুম প্রথমে ট্রাকে করে চকরিয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। আরো ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর মানিক কাভার্ড ভ্যান নিয়ে পেছনে পেছনে আসতে থাকে।


এমন কৌশলের কারণ হিসেবে র‌্যাব জানায়, তাদের পরিকল্পনা ছিল সামনের ট্রাকটি ধরা পড়লে পেছনের কাভার্ড ভ্যানে রক্ষিত মূল চালান যেন রক্ষা পায়। এ ছাড়াও সীতাকুন্ড ও কুমিল্লায় যাত্রা বিরতিও করেছে তারা।


র‌্যাব আরো জানায়, কেরানীগঞ্জে লবণ নামানোর পর ঢাকায় বসিলায় একটি নির্ধারিত স্থানে কাভার্ড ভ্যানের প্রকোষ্ঠটি কেটে ইয়াবাগুলো বের করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। পরে বাকি তিন জনের সহায়তায় বিভিন্ন স্থানে ৫ জন মাদক ব্যবসায়ীর নিকট তা হস্তান্তর করা এবং মাসুমের ট্রাক থেকে ইয়াবাভর্তি অতিরিক্ত চাকাটি অদলবদল করে ইয়াবা হস্থান্তর করা।



আটকদের নেই লাইসেন্স



র‌্যাব জানায়, কাভার্ড ভ্যানচালক মানিকের গাড়ি চালনার প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। এমনকি তার ভারী যানবাহন চালনার ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। সে লেগুনা চালাতো। আটক মানিক কুমিল্লায় লেগুনা চালনাকালে তার সাথে কুমিল্লা্র ট্রাকচালক আউয়ালের পরিচয় হয়। ওই আউয়ালের সহযোগিতায় সে ইয়াবা পরিবহনে জড়িয়ে পড়ে। ওই আওয়াল ও আটকৃত মানিক বর্ণিত কাভার্ড ভ্যান নিয়ে টেকনাফ থেকে রওনা করেছিল। উভয়ে পালাক্রমে টেকনাফ থেকে চালিয়ে কুমিল্লা পর্যন্ত নিয়ে আসে। কুমিল্লা এসে আওয়াল ট্রাক থেকে নেমে যায় এবং আরিফ সহকারী হিসেবে ওই ট্রাকে ওঠে। আরিফ বর্তমানে পেশায় হেলপার। সেও আওয়ালের মাধ্যমে এই দুষ্টচক্রে যুক্ত হয়। এর আগে সে ছিল ইজিবাইকচালক। সে কুমিল্লা শহরে ৩ বছর ইজিবাইক চালিয়েছে।



আটককৃত অপর আসামি মাসুম মিয়া একজন ট্রাকচালক। কিন্তু তারও কোনো লাইসেন্স নেই। সে আরেক ট্রাকচালক জাকারিয়ার প্ররোচনায় বাস চালনা বাদ দিয়ে কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী লবণবাহী পরিবহন চালানো শুরু করে।


ট্রাকের হেলপার গ্রেফতারকৃত অপর আসামি আব্দুল খালেক ইতিপূর্বে রাজমিস্ত্রি ছিল। সে টেকনাফের রফিকের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে যোগ দেয়। সে রফিকের মাধ্যমেই আটককৃত আসামি মাসুমের ট্রাকের হেলপার হিসেবে নিয়োগ পায়।


এ ব্যাপার র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, এই চক্রটির সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। যারা সকলেই পরিবহন সেক্টরে কর্মরত এবং ছদ্মবেশে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত।


আটকরা বিগত এক বছর থেকে এই পেশায় জড়িত জানিয়ে র‌্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, এক বছরে তারা মোট ৮টি চালান পাচার করেছে। এই চক্রটির নিয়ন্ত্রণকারী টেকনাফের রফিক দালাল এবং ব্যবস্থাপনার সার্বিক দায়িত্বে রয়েছে চালক মাসুম। তারাও পরিবহন সেক্টরে কাজ করে।


পরিবহন সেক্টরে এধরনের আরো বেশ-কয়েকটি সিন্ডিকেট বিদ্যমান রয়েছে জানিয়ে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, কক্সবাজারের কতিপয় দালাল মাদক ডিলারদের যোগসাজসে পণ্যবাহী পরিবহনের চালক ও সহকারীকে মোটা অংকের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের গাড়িতে ইয়াবা ট্যাবলেট পরিবহন করে থাকে। এজন্য ওই দালালরা একটি কমিশন অথবা লভ্যাংশ পেয়ে থাকে। মাদক লেনদেনের অর্থ সাধারণ ব্যাংক, ইলেক্ট্রনিক মানি ট্রান্সফার বা হুন্ডির মাধ্যমে হস্থান্তর হয়ে থাকে। পরে অবৈধ পন্থায় মিয়ানমারের সিন্ডিকেটের বা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করা হয়ে থাকে।


ওই সিন্ডিকেটের সবাইকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় গত ৩ মে থেকে সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। ওই অভিযানে ৩৯৭৯ জন মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার করা হয়েছে। ৬৫১৯ জনকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়াও ১০৯৭ জনকে জরিমানা করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ১১৬ কোটি টাকার মাদক।


বিবার্তা/খলিল/হুমায়ুন/সোহান

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com