শিরোনাম
নির্বাচনী বছর : অর্থনীতিতে ঝুঁকি
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৯:২৫
নির্বাচনী বছর : অর্থনীতিতে ঝুঁকি
মৌসুমী ইসলাম
প্রিন্ট অ-অ+

চলতি বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে নানা সমীকরণ। অর্থনীতিতেও ছড়িয়ে পড়েছে তার উত্তাপ। আগের নির্বাচনী বছরগুলোতে অনিশ্চয়তায় থমকে যায় বেসরকারি বিনিয়োগ। এবারও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না সেই আশঙ্কা। এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার রায়কে ঘিরে শুরু হয়েছে উত্তেজনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, নানাবিধ আশঙ্কায় নড়বড়ে হবে অর্থনীতির সূচক।


হঠাৎ পুঁজিবাজারে ধস


সপ্তাহের প্রথমদিন রবিবার হঠাৎ করেই আসে দুঃসংবাদ - পুঁজিবাজারে ধস। দিনশেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূল সূচক কমে যায় ১৩৩ পয়েন্ট। অন্যদিকে চট্টগ্রাম শেয়ার বাজারে সূচক পড়ে যায় ৪০৪ পয়েন্ট।


খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দুর্বলতার কারণে পুঁজিবাজারে এ দরপতন বলে মনে করছে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন।


এর আগে ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল ডিএসইএক্সের সর্বোচ্চ পতন হয়। সেদিন এই সূচক ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ কমে ৪ হাজার ৯৪ পয়েন্টে নামে।


ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কা


নির্বাচনী বছরে কমে যায় ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি। কয়েক বছরের তথ্য বলছে, যে বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই বছরেই বাড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ীরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। ফলে সংকুচিত হয় বিনিয়োগ। এ বছরও নির্বাচন, তাই রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলে কমে যাবে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ। ১৯৮৬ সাল থেকে সর্বশেষ ২০১৪ সাল পর‌্যন্ত ছয়টি নির্বাচনের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল ১৯৯০ সালে। ওই নির্বাচনের বছরেই শুধু প্রবৃদ্ধি বাড়ে। স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক ধারায় উত্তরণের কারণেই পাল্টে যায় প্রবৃদ্ধির গতি।


১৯৮৬ সালে নির্বাচনী বছরে ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাইনাস (-)১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। তবে আগের বছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ১২ শতাংশ। ১৯৯০ সালে নির্বাচনী বছরে ঘুরে দাঁড়ায় প্রবৃদ্ধির সূচক। দেখা যায়, ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তবে আগের ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয় ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের বছরে আবার কমে যায় প্রবৃদ্ধি। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তবে আগের অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয় ২১ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০০১ সালের নির্বাচনের বছরেও কিছুটা কমে প্রবৃদ্ধি। দেখা যায়, ২০০১-০২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয় ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তবে আগের অর্থবছরে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০০৯ সালের সংসদ নির্বাচনেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, তাই কমে যায় বিনিয়োগ। ফলে প্রবৃদ্ধিতেও তার প্রভাব দেখা যায়। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেখানো প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ, সেখানে নির্বাচনের বছর অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে হয় ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির চাপ স্পষ্ট হয়। দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যেখানে ৬ দশমিক ৭২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়, সেখানে নির্বাচনের আগের বছর অর্থাৎ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।


এই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে তৈরী হয়েছে শঙ্কা। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা যেহেতু উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না, তাই ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ নিয়েও তৈরি হয়েছে দুশ্চিন্তা। তথ্য বলছে, সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির গতি মন্থর। আট বছর আগে যেখানে মোট বিনিয়োগে সরকারি অংশীদারিত্ব ছিল ১৬ ভাগ, এখন সেই হার বেড়ে হয়েছে এক-চতুর্থাংশ।


রফতানি আয় নিয়ে চিন্তা


নির্বাচনকেন্দ্রিক অস্থিরতা তৈরি হলে কমে যেতে পারে রফতানি আয়। হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে উৎপাদন কমে যায়। উৎপাদিত পণ্য পরিবহন ও শিপমেন্টও বাধাগ্রস্থ হয়। ক্রেতাদের আসার ক্ষেত্রে তৈরী হয় অনিশ্চয়তা।


এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট অস্থিরতায় কমে যায় রফতানি আয়। এবারও সেই আশঙ্কা রয়েছে। চলতি অর্থবছরে রফতানি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৩৭ বিলিয়ন ডলার। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জানুয়ারী মাসে পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছে ৩৪১ কোটি মার্কিন ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আড়াই শতাংশ কম। ২০২১ সালে রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেয়ার লক্ষ্য নির্দিষ্ট করেছে সরকার। বিশাল এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শুধু রাজনৈতিক ঝুঁকিই নয়, সামনে এসেছে প্রতিযোগী দেশগুলোর নানাবিধ ষড়যন্ত্রও। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারীতে রফতানি আয় ৩৪১ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আড়াই ভাগ কম।


মূল্যস্ফীতির উত্তাপ


গত ডিসেম্বর শেষে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ, আগের মাসে ছিল ৭ দশমিক ০৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে শহরে খাদ্যমূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ২২ শতাংশ এবং গ্রামে ছিল ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্য কিনতে প্রায় ৭ টাকা বেশি দিচ্ছে ক্রেতা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয় সাড়ে ৫ শতাংশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলে বেড়ে যাবে পণ্যমূল্য। কারণ, আগের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। সহিংস কর্মসূচির কারণে পণ্য পরিবহনে সংকট তৈরী হয়, ফলে পণ্যের ঘাটতির কারণে বাড়ে দাম। বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্যমূল্যস্ফীতির ঝুঁকি রয়েছে। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে বোরো মৌসুম পর্যন্ত পর্যাপ্ত মজুদ রাখতে হবে, যাতে বাজারে হস্তক্ষেপ করা যায়।


এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ৮ ফ্রেব্রুয়ারির মতো এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। শেয়ারবাজারে এ কারণে ধস নামছে বলে আমার মনে হয় না। এটা ব্যাংকের ঋণসীমা কমিয়ে দেয়ার কারণে হতে পারে। পুঁজিবাজার নিয়ে ম্যানিপুলেশন এর আগেও হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে পুঁজিবাজারে কিছু না হলেও পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়তে পারে।


মূল্যস্ফীতি বিষয়ে তিনি বলেন, বাজার এখন স্থিতিশীল আছে। মূল্যস্ফীতির চাপ থাকবেই। বিভিন্ন কারণে হঠাৎ করে এটা কমানো কঠিন।


রফতানিতে এর প্রভাব নিয়ে তিনি বলেন, এখনো বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়নি। অভ্যন্তরীন রাজনীতির কারণে রফতানিতে বড় ধরনের প্রভাব এর আগেও পড়েনি। রফতানি বাজার নির্ভর করে যে বাজারে পণ্য পাঠানো হয় সেই বাজারের অবস্থার ওপর। এজন্য রফতানিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে না। তবে নির্বাচনের বছরে বিনিয়োগ স্বাভাবিকভাবে কমে যায়। এবারও সেই আশঙ্কা রয়েছে।


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com