শিরোনাম
একজন মিল্টন সমাদ্দারের মানবিক লড়াই
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৭:৫৯
একজন মিল্টন সমাদ্দারের মানবিক লড়াই
খলিলুর রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

‘শোন বন্ধু শোন, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা/ইটের পাঁজরে, লোহার খাঁচায় দারুণ মর্মব্যথা’।


আধুনিক মানুষের জীবনে এই মর্মব্যথা হয়েছে আরো তীব্র, বিশেষ করে নগর জীবনে। ইট-কাঠ-পাথরের নগরীতে বাস করতে করতেই বুঝি বা মানুষ খানিকটা অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। হয়ে গেছে কিছুটা অমানবিক ও নিষ্ঠুরও। তাই তো এককালের অতি প্রিয়জন, এমনকি বৃদ্ধ মা-বাবাকে অবহেলা বা ত্যাগ করতেও বুক কাঁপে না তাদের।


কিন্তু সবাই অমানুষ হয় না। যেমন হননি রাজধানী ঢাকার কল্যাণপুরের বাসিন্দা মিলটন সমাদ্দার। সমাজের অবহেলিত মানুষগুলোকে আশ্রয় দিতে গড়ে তুলেছেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রায় দেড় বছর ধরে ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি ৬০ জন প্রবীণ নারী-পুরুষকে আশ্রয় দিয়ে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।



কল্যাণপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ার ৮ নম্বর রোডে ৬২/২ নম্বর বাসায় ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামের ওই প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান। ৩১ জানুয়ারি ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, নারী-পুরুষদের কেউ ঘুমাচ্ছেন, কেউবা টিভি দেখছেন। তাদের কেউ কেউ জটিল রোগে ভুগছেন। তাদের সবার জীবনের ''শেষ পারাণির কড়ি'' এখন মিলটন সমাদ্দার।


কে এই মিলটন সমাদ্দার? না, তিনি কোনো বিশাল ব্যবসায়ী বা ধনপতি নন। নন কোনো নেতা বা অভিনেতা কিংবা তারকা। একেবারেই সাধারণ একজন মানুষ তিনি, যিনি মানুষের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ থেকে গড়ে তুলেছেন অসাধারণ এ প্রতিষ্ঠানটি।



কিভাবে সেটা - জানতে চাইলে মিল্টন সমাদ্দার বিবার্তাকে জানান লেখাপড়া শেষ করে একদল সেবক-সেবিকা নিয়ে ছোট একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। কাজ হলো, যে বাড়িতে কোনো প্রবীণ আছেন অথচ তাদের সময় ও সেবা দেয়ার মতো লোকের অভাব, সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে সেসব বাসায় গিয়ে তাদের সেবা দান। কাজটি করতে-করতে মিল্টন একরকম মায়ায় জড়িয়ে যান। ভাবতে থাকেন এ মানুষগুলোর জন্য আরো বড় পরিসরে কী করা যায়। এক পর্যায়ে তিনি অসহায় ও সন্তানহারা বৃদ্ধ মানুষদের জন্য একটি আশ্রয় কেন্দ্রে গড়ে তোলার কাজে নেমে পড়েন।


২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে রাস্তায় পড়ে থাকা এক বৃদ্ধকে তুলে আনার মধ্য দিয়েই মিল্টন সমাদ্দার শুরু করেন তাঁর মানবিক লড়াই। সেই থেকে এ পর্যন্ত তিনি ৬০ জন বৃদ্ধ নারী-পুরুষকে আশ্রয় দিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই মারা গেছেন, আবার অনেককেই তাদের সন্তানরা নিয়ে গেছেন। বর্তমানে ১২ জন নারী ও ৫ জন পুরুষের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করছেন মিলটন।



মিল্টন তাঁর প্রতিষ্ঠানে আশ্রয়প্রাপ্ত মানুষগুলোর খাদ্য, চিকিৎসা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করেছেন। বিনোদনের জন্য টিভি রাখা হয়েছে। মাঝে-মধ্যে গল্পের আসরও জমানো হয়।


ওখানকার বাসিন্দাদের প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে রুটি, সবজি, ডাল, কলা, ডিম অথবা খিচুড়ি খাওয়নো হয়। সাড়ে ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত টিভি দেখা বা আড্ডা হয়। আবার কেউ এসময় বিশ্রামও নিতে পারেন। সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে চা-বিস্কুট অথবা ফল, মিষ্টি, নুডুলস খাওয়ানো হয়। এরপর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে সবাইকে গোসল করানো হয় এবং দুপুর ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে ভাত, সবজি, মাছ, মাংস, ডাল, ভর্তা ইত্যাদি খাওয়ানো হয়। বিকাল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে চা, বিস্কুট, ফল, মিষ্টি, নুডুলস এবং রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে খাওয়ানো হয় ভাত, সবজি, মাছ, ডাল, ভর্তা।


আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসকারীদের প্রতিদিন তিনবার প্রেসার, ব্লাড, ডায়বেটিস চেক করা হয়। সকাল, দুপুর ও রাতে তাদের ওষুধ সেবন করানো হয়। আর রাত ১০টার মধ্যে সবাইকে ঘুম পাড়ানো হয়।



ওই প্রতিষ্ঠানে ৫ জন কর্মচারী রয়েছেন। প্রতিমাসে তাদের বেতন বাবদ লাগে ৫৫ হাজার টাকা। এছাড়া বাড়িভাড়া ৬৮ হাজার টাকা, খাবারে আনুমানিক ৩০ হাজার টাকা, চিকিৎসায় ৩০ হাজার টাকা, বিবিধ আরো ১৫ হাজার টাকাসহ প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা প্রতি মাসে ব্যয় হয়। প্রতি মাসে এত টাকা সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতে হয় মিলটনকে।


তাহলে কিভাবে চলছে ? চলছে সমাজের হৃদয়বান কিছু মানুষ এখনো আছেন বলে। তারা কিছু-না-কিছু সাহায্য সবসময়েই করেন। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানেও তারা এদের কথা ভোলেন না।


এছাড়া সম্প্রতি ফেসবুকেও সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলে মিল্টন সমাদ্দার। এতে যে সাড়া পেয়েছেন তাতেও অভিভূত তিনি। এভাবেই চলছে,শত কষ্টের মধ্যেও।



মিলটন বলেন, সমাজে অনেক বিত্তবান লোক রয়েছেন। তারা যদি এগিয়ে আসেন তাহলে একে আরো ভালোভাবে চালানো যাবে। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, কর্মচারী বেতন বা খাবারের টাকা যোগাড় করতে প্রতিমাসে তার নাভিশ্বাস ওঠে। সবাই এগিয়ে এলে এ কষ্ট আর থাকতো না।


এ ছাড়া আরো কষ্ট আছে। যেমন, বৃদ্ধাশ্রমে কারো মৃত্যু হলে কবর দেয়া অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কারণ, রাজধানীতে কবর দিতে হলে তাদের জন্মনিবন্ধন কার্ড অথবা জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। কবরের জায়গাটিও কিনে নিতে হয়। এসব বিষয় মিলটনকে ভীষণ পীড়া দেয়। তাই বিষয়টির দিকে নজর দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।


(এ প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে ফেসবুকে child and old age care লিখে সার্চ দিতে পারেন)


বিবার্তা/খলিল/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com