‘এখনো মনে হয় কেউ তাঁকে কালো কাপড় দিয়ে সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে। জীবনটা একটা সময় বর্ডার লাইনে চলে যায়। যদি বেঁচে থাকতে হয়, কিভাবে বাচবো? এমন হাজারো প্রশ্নে নিজেকে ভাবিয়ে তুলি। অন্ধ হওয়ার পর পরিচিতরাও অপরিচিত হয়ে যায়। নতুন করে বেচে থাকার উপায় খুজঁতে থাকি।’ এভাবেই নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে চোখের কোণা হাতের আঙ্গুল দিয়ে মুছতে থাকেন লাল হিম বম। এখন জেলা পরষদে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়াবেন তিনি।
চোখের আলো নিয়েই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন লাল হিম বম। ২০০৫ সালে একটি বেসরকারী সংস্থায় চাকুরী করতেন মেধাবী এ তরুণ। এক সময় পৃথিবীর আলো দেখতে পেলেও ভুল চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হারান।
বাবা টি.এস বম ছিলেন বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য। বুধবার বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের একটি কক্ষে বসে একান্ত কথাবার্তায় তুলে ধরেন জীবনের ট্রাজেডির কথাগুলো।
লাল হিম বম এ প্রতিবেদককে জানান, ছোটকাল থেকে চোখের সমস্যা ছিল তার। ভারতে যখন অধ্যয়নরত ছিলেন তখন চোখের চিকিৎসা শুরু হয়। পরে ২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত দেশে এসে ঢাকায় একটি বেসরকারী সংস্থায় চাকরী শুরু করেন। একটা সময় ভারতে চারটি প্রশিক্ষণের জন্য ১১টি এনজিও নিয়ে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া তাকে।
সে সময় উড়ন্ত আধুনিক চক্ষু হাসপাতাল বা (অরবিস) এর সাথে পরিচয় ঘটে। যোগাযোগের পর চিকিৎসকরা বলেছিলেন- এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে ছোট একটি অপারেশন করলেই চোখ ভাল হয়ে যাবে। লাল হিম বমের সিদ্ধান্তের পর অপারেশন করে আই প্যাচ বা চোখের পট্টি বেধে দেওয়া হলো তাকে। বর্তমান আধুনিক নিয়মানুযায়ী চোখ অপারেশনের দুই দিন পরই পট্টি খুলে ফেলার কথা। কিন্তু ডাক্তার প্রতিদিন চোখ দেখে আবার পট্টি বেধে দিতে থাকেন। ১১দিনের মাথায় আবারো অপারেশন হয়।
অস্বাভাবিক এমন কাজের পর ডাক্তারের কাছে হিম বম জানতে চেয়েছিলেন, আগে চোখ খুললে একটু দেখতে পেতাম। কিন্তু এখন আর চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। বাম চোখও ঝাপসা হয়ে আসছে। জবাবে ডাক্তার বলেছিলেন, ‘স্যরি তোমার চোখে আমরা একটি টিউপ দিয়েছিলাম পানি যাওয়ার রাস্তা করার জন্য। সেটি বেশি লম্বা হয়ে গেছে। চোখে নুন্যতম যে পানি থাকার কথা তা বের হয়ে গেছে। ফলে পুরো চোখ বসে গিয়ে কর্ণিয়াটা নষ্ট হয়ে গেছে।
লাল হিম বম জানান, মূলত তার চোখের নেত্রনালির সমস্যা ছিল। কিন্তু ডাক্তার নষ্ট করে ফেলেন কর্ণিয়া।
আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গিয়েছি একা কিন্তু বের হয়েছি অন্যজনের হাত ধরে। যার কারণে ১১টি এনজির দায়িত্ব পেয়েও চাকরি হারিয়ে অনিশ্চিত জীবন কাটাতে হয়েছে।’
চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এভাবে কেটেছে দীর্ঘসময়। সম্প্রতি লাল হিম বমকে চাকরি দিলেন বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা। সপ্তাহের বৃহস্পতি ও শুক্রবার দুইদিন জেলা পরিষদে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবেন লালহিম। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।
উল্লেখ্য, লাল হিম বম ১৯৯০ সালে এসএসসি পাস, ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যাল থেকে বিবিএ একাউন্টিং এবং ২০০২ সালে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি রয়েল রোড়স থেকে এমবিএ করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবান সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের রিসোর্স শিক্ষক সত্যজিৎ মজুমদার এ প্রতিবেদককে বলেন, লাল হিম বম জীবনের নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার কারনেই আজ সফল হয়েছেন। জেলা পরিষদ তাঁকে চাকরী দেওয়ার মাধ্যমে পুরো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সম্মান জানিয়েছেন। লাল হিম বম একজন মেধাসম্পন্ন ব্যাক্তি। আমার বিশ্বাস ইংরেজী প্রশিক্ষক হিসেবে জয় লাভ করে দৃষ্টি হারা মানুষের চলার পথের পথিক হবেন তিনি।
বিবার্তা/নয়ন/ইমদাদ