শিরোনাম
স্বেচ্ছায় ‘একঘরে’ থাকতো জঙ্গি সাজ্জাদের পরিবার
প্রকাশ : ১৪ মে ২০১৭, ২২:২৭
স্বেচ্ছায় ‘একঘরে’ থাকতো জঙ্গি সাজ্জাদের পরিবার
রিমন রহমান, রাজশাহী
প্রিন্ট অ-অ+

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বেনীপুরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত সাজ্জাদ আলীর পরিবার স্বেচ্ছায় ‘একঘরে’ থাকতো। পরিবারটি এলাকার কারও সাথে মিশতো না, মানতো না গ্রামের রীতিনীতি। এ নিয়ে সাজ্জাদের শ্বশুর লুৎফর রহমান ছিলেন বেকায়দায়।


রবিবার দুপুরে লুৎফর রহমান নিজেই এসব কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আগে তার জামাতা সাজ্জাদ ও মেয়ে বেলী আক্তার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতো। কিন্তু ৫-৬ বছর থেকে তারা পাল্টে যায়। তারা গ্রামের কোনো মানুষের সঙ্গেই মিশতো না। এমনকি শ্বশুর বাড়ির সঙ্গেও চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল সাজ্জাদ।


লুৎফর রহমান বলেন, মুখে দাড়ি থাকলেও সাজ্জাদ মসজিদে নামাজ পড়তে যেতো না। কিন্তু গ্রামের রীতি অনুযায়ী ঈদের নামাজ ও তারাবির নামাজের জন্য সব বাড়ি থেকেই টাকা উঠানো হয়। সাজ্জাদ এই টাকা কোনো দিন দিতো না। মসজিদের উন্নয়নে গ্রামবাসী সপ্তাহে সাত মুঠো চাল দান করেন। বেলী আক্তার এই চালও কোনো দিন দিতো না। বেলী নিজের মেয়ে হওয়ায় মসজিদ কমিটির লোকজন লুৎফর রহমানের কাছেই এসব অভিযোগ করতেন।


বৃহস্পতিবার বেনীপুরে জঙ্গি সাজ্জাদের বাড়িতে অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ সময় সাজ্জাদসহ তার পরিবারের সদস্যরা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এতে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী নিহত এবং চার পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে আত্মঘাতি বোমার বিস্ফোরণে সাজ্জাদ আলী (৫০), তার স্ত্রী বেলী আক্তার (৪০), ছেলে আল-আমিন (২৩), মেয়ে কারিমা খাতুন (১৭) এবং বহিরাগত শীর্ষ জঙ্গি আশরাফুল ইসলাম (২৩) নিহত হয়।


বেনীপুরের মাঠে যে জমিতে সাজ্জাদ বাড়ি করেছিলেন, সেটির চারপাশেই ধান চাষ করা হয়। দু’মাস আগে বাড়িটি তৈরির সময়ও চারপাশে বোরো ধান ছিল। এমন নির্জন স্থানে বাড়ি করার কারণ হিসেবে লুৎফর রহমান মনে করেন, ‘একঘরে’ থাকতেই সাজ্জাদ সেখানে বাড়ি করেছিলেন।


তিনি বলেন, ‘এখন সব প্রমাণিত হয়েছে। বলতে সমস্যা নাই। ‘একঘরে’ থেকে জঙ্গি কার্যক্রম চালাতেই নির্জন মাঠে বাড়ি করেছিল সাজ্জাদ।’


লুৎফর রহমান জানান, প্রায় ২৫ বছর আগে সাজ্জাদের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেন। এরপর সে বেনীপুর গ্রামে বাবা-মায়ের সঙ্গেই ছিল। বিয়ের পাঁচ বছর পর শ্বশুরের গ্রামে একটি খাস জমিতে বাড়ি করেন। কিন্তু ওই জায়গাটি ছিল নিরিবিলি। তাই সাজ্জাদ তখন বলেছিল, ওখানে সে একা থাকতে পারবে না। এরপর লুৎফর রহমান তার নিজের কিছু এবং আরো কিছু জায়গা কিনে মাছমারা গ্রামে সাজ্জাদকে তার বাড়ির পাশে বাড়ি করে দেন।


এরপর ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু বছর ছয়েক আগে থেকে পাল্টে যেতে থাকে সাজ্জাদের পরিবার। সাজ্জাদের পুরো পরিবার পর্দাশীল হয়ে ওঠে। তারা কেউ বাড়ির বাইরেই বের হতো না। বাইরে থেকে খাবার পানি নিয়ে যেতো সাজ্জাদ। সে তার সব ছেলে-মেয়েকে ভর্তি করেছিল মাদ্রাসায়। দর্জির কাজের সময় বাড়িতে কোনো নারী গেলে তাকে ইসলামের কথা শোনাতে শুরু করে বেলী আক্তার। মাদ্রাসা পড়োয়া ছেলেদের সঙ্গেও বাড়িতে আনাগোনা বাড়তে থাকে অচেনা যুবকদের।


বেলী আক্তারের ভাই শরিফুল ইসলাম (৩৫) বলেন, তার ভাগ্নেই মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিল। বড় ভাগ্নে সোয়েব কিছুদিন পর পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। কিন্তু আল-আমিন পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল। তার সঙ্গেই বাড়িতে অচেনা যুবকরা আসতো। তাদের পরনে থাকত পাঞ্জাবি-পাজামা। মুখে থাকতো দাড়ি। তারা কে, জানতে চাইলে আল-আমিন তার মামাকে কখনও তাদের ‘ওস্তাদ’ আবার কখনও সহপাঠি বলে পরিচয় দিতো।


লুৎফর রহমান বলেন, নিজের এক নাতনির সঙ্গে আল-আমিনের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এতে রাজি হয়নি মেয়ে-জামাই। মূলত এই বিষয়টি নিয়েই বছর তিনেক থেকে মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়ে। পাশাপাশি বাড়ি হলেও কথাও বন্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে প্রায় ৬ মাস আগে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাজ্জাদ তাকে ‘লাঞ্ছিত’ করে। এ ঘটনায় থানায় বিচার হয়। ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় সাজ্জাদ আলীকে।


এরপরই হঠাৎ শুনতে পান সাজ্জাদ তার ভিটে বিক্রি করে দিয়েছে। তারপর সাজ্জাদ তার পুরো পরিবার নিয়ে উপজেলা সদরের দিকে চলে যায়। সেখানে মাস চারেক ভাড়া থাকে। এরপর মাস দুয়েক আগে লুৎফর রহমান আবার হঠাৎ শুনতে পান, সাজ্জাদ তার মায়ের গ্রামের শেষপ্রান্তে ধানী জমিতে বাড়ি করেছে। কিন্তু সে বাড়িতে তার যাওয়া হয়নি। গত বৃহস্পতিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনতে পান ওই বাড়িতেই বোমার বিস্ফোরণে মারা গেছে সবাই।


সাজ্জাদসহ তার পরিবারের সদস্যদের লাশ গ্রহণ করেননি সাজ্জাদের মা ও ভাই। লুৎফর রহমানও মেয়ে-জামাই-নাতি ও নাতনির লাশ নেননি।


এপ্রসঙ্গে লুৎফর বলেন, ওরা দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতো। ওই নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য বেছে নিয়েছে। লাশ নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে একমাত্র মেয়ের জন্য মন ঠিকই কাঁদছে। তারপরেও কিছু করার ছিল না।


বৃহস্পতিবার ‘জঙ্গি বাড়িতে’ অভিযানের সময় সাজ্জাদের বড় ছেলে সোয়েব আলী বাড়িতে ছিল না। আর বড় মেয়ে সুমাইয়া আত্মসমর্পণ করেছে। সুমাইয়া এখন রিমান্ডে। আর সোয়েবকে খুঁজছে পুলিশ। তাদের নানা লুৎফর রহমান বলছেন, সোয়েবের উচিৎ আত্মসমর্পণ করে আইনের আওতায় যাওয়া। এতে তারই লাভ। আর সুমাইয়ার উচিৎ তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহায়তা করা।


বিবার্তা/রিমন/আকবর

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com