শিরোনাম
যেভাবে আত্মঘাতী হয়ে ওঠে রাজশাহীর পাঁচ জঙ্গি
প্রকাশ : ১৩ মে ২০১৭, ১০:০৮
যেভাবে আত্মঘাতী হয়ে ওঠে রাজশাহীর পাঁচ জঙ্গি
রিমন রহমান, রাজশাহী ব্যুরো
প্রিন্ট অ-অ+

জঙ্গি সাজ্জাদ আলীর চাচাতো ভাই মনিরুল ইসলাম ছিলেন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) দুর্ধর্ষ ক্যাডার। জেএমবির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের হাত ধরে ২০০৫ সালের দিকে মনিরুল জেএমবিতে যোগ দেয়। ওই সময়ই মনিরুলের হাত ধরে জেএমবিতে যোগ দেন সাজ্জাদ আলী।


সরকারি একটি গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র এমন তথ্যই জানিয়েছে। সূত্র বলছে, সাজ্জাদ জেএমবিতে যোগ দেয়ার কিছুদিন পরই মনিরুল চট্টগ্রামে অস্ত্রসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ১০ বছরের জেল হয় তার। ফলে সাজ্জাদ আলী ‘সাংগঠনিকভাবে’ আর বেশিদূর এগোতে পারেননি। মাঝে বাংলা ভাইয়েরও ফাঁসি হয়ে যায়। এতে সাংগঠনিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন সাজ্জাদ।


কিন্তু জেএমবির ‘আদর্শ’ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। এদিকে বছর দুয়েক আগে কারাভোগ শেষে মনিরুল গ্রামে ফেরেন। এই সময় পুরাতন জেএমবিও নব্য জেএমবি হয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করে। আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন সাজ্জাদ। যোগাযোগ বাড়ে জেএমবি সদস্যদের সঙ্গে। মূলত সাজ্জাদই তার পুরো পরিবারকে জঙ্গিদের সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য বানিয়ে ফেলেন।


গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর উপজেলার বেনীপুর গ্রামে সাজ্জাদ আলীর বাড়িতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সাজ্জাদ আলীর পরিবারের সদস্যদের হামলায় এক ফায়ার সার্ভিসকর্মী নিহত হন। আহত হন আরও দুই পুলিশ সদস্য। এরপর সাজ্জাদ আলীসহ (৫০) তার স্ত্রী বেলী আক্তার (৪৫), তাদের ছেলে আল-আমিন ওরফে হামজা (২০), মেয়ে কারিমা খাতুন (১৭) এবং বহিরাগত শীর্ষ জঙ্গি আশরাফুল ইসলাম (২৩) আত্মঘাতি বোমার বিস্ফোরণে নিহত হয়।


দেশে এখন পর্যন্ত আত্মঘাতীবোমায় অনেকেই নিহত হলেও একই পরিবারের চার সদস্যের এমন আত্মহত্যা এবারই প্রথম। অভিযানের প্রথম দিন যেভাবে নারী জঙ্গি বেলী পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ওপর প্রকাশ্যে যে উন্মত্ত হামলা চালিয়েছে, তাও প্রথমবারের মতো দেখেছে বাংলাদেশ।


সাজ্জাদ আলীর গ্রামের লোকজন বলছেন, সাজ্জাদ এলাকায় ‘মিষ্টু’ নামে পরিচিত। এখনও গ্রামের মানুষ তাকে পুরনো জেএমবি বলে জানেন। তবে বেশ কিছু দিন তার সাংগঠনিক তৎপরতা কেউ বুঝতে পারেননি। সাধারণ মানুষের মতো তিনিও সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে কাপড় বিক্রি করতেন।


আর তার স্ত্রী বেলী আক্তার বাড়িতে দর্জির কাজ করতেন। তার কাছে কোনো নারী কাপড়ের কাজে গেলে তাকে ইসলামের তালিম দিতেন বেলী। তবে পরিবারের সব নারী সদস্যই অন্য নারীদের সামনেও পর্দা বজায় রাখতেন।


প্রতিবেশীরা জানান, প্রায় দুই মাস হলো মাঠের মধ্যে এই বাড়িটি করেছিলেন সাজ্জাদ। এর আগে প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি পাশের গ্রাম মাছমারায় শ্বশুর বাড়ির পাশেই বাড়ি করে থাকতেন। ওই বাড়িতে নিয়মিত ইসলামী বৈঠক বসাতেন সাজ্জাদের স্ত্রী বেলী আক্তার। গ্রামের নারীদের ডেকে ইসলামের কথা শোনাতেন তিনি।


নতুন বাড়িতে আসার পরও বেলী দর্জির কাজ করতেন। এখানে আসার পর বেলী আক্তারসহ দুই মেয়ে সুমাইয়া ও কারিমার মুখ কখনও দিনের আলোতে দেখেননি প্রতিবেশীরা। তারা প্রতিবেশীদের কারও বাড়ি যেতেন না। সাজ্জাদের পরিবারের এই তিন নারী দিনে দুইবার বাড়ির বাইরে পানি নিতে বের হতেন। একবার রাত ১০টার পর এবং আরেকবার ভোরের আলো ফোটার আগে। কোথাও গেলে তারা বোরখা পরে বের হতেন। হাতের কব্জি আর চোখ ছাড়া তাদের কিছুই দেখা যেত না। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের ওপর হামলা চালানোর সময়ও কালো রঙের বোরখা পরে ছিলেন বেলী আক্তার।


স্থানীয় কয়েকজন যুবক জানান, সাজ্জাদ আলীর ছেলে সোয়েব আলী ও আল-আমিন আগে দাঁড়ি কামাতো না। তারা বলতো- তারা কখনও গালে ব্লেড ঠেকায়নি, ঠেকাবেও না। তবে কয়েকমাস আগে তারা দাঁড়ি কামিয়েছিল। তারা কারও সঙ্গে কখনও ঘনিষ্ঠভাবে মিশতোও না। যতটা সম্ভব এলাকার মানুষকে এড়িয়ে চলত।


সাজ্জাদ আলীর মেয়ে সুমাইয়ার স্বামী জহুরুলকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে প্রায় ৬ মাস আগে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়িতে থাকতেন সুমাইয়া। অভিযানের সময় শুধু সুমাইয়া আত্মসমর্পণ করে। তার দুই শিশু সন্তানকেও বাড়ির পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয়রা ধারণা করছেন, জঙ্গি সাজ্জাদ তার জামাইকেও জঙ্গিবাদে জড়িয়েছিলেন। আর জহুরুলকে প্রথমে গ্রেপ্তারের পরই সাজ্জাদের ব্যাপারে তথ্য পায় পুলিশ।


জহুরুলের ভাই মিনারুল ইসলাম বেনীপুর জামে মসজিদের ঈমাম। তিনি জানান, সাজ্জাদ আলী ও তার দুই ছেলেরা মসজিদে নামাজ পড়তে আসতো না। আত্মীয় বলে তিনি অনেকবার নামাজের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু তারা তাকে জানিয়েছিল- তারা ‘ইবাদাত’ করে। মসজিদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।


মাছমারা গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, শ্বশুর বাড়ির পাশে যখন সাজ্জাদ বাড়ি করে থাকতেন, তখন শ্বশুর লুৎফার রহমানের সঙ্গে তার ধর্মীয় রীতিনীতি মিলত না। মেয়ে বেলী আক্তারও তার বাবার কথা শুনতেন না। এ জন্য প্রায়ই তাদের লুৎফার রহমানের সঙ্গে গ-গোল হতো। কয়েকমাস আগে সাজ্জাদ তার শ্বশুরকেই মারপিট করেন।


এ ঘটনায় থানায় বিচারও হয়। বিচারে সাজ্জাদ আলীকে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এরপরই সাজ্জাদ শ্বশুরের ভিটা ছেড়ে মহিষালবাড়ি এলাকায় গিয়ে বাসা ভাড়া নেন। তার মা মারজাহান বিবি তখন সাজ্জাদকে বেনীপুরের বিলে পাঁচ কাঠা জমি দেন বাড়ি করার জন্য। এই বাড়িতেই গত বৃহস্পতিবার থেকে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে আত্মহুতি দেন পরিবারের চার সদস্যসহ বহিরাগত জঙ্গি আশরাফুল।


পুলিশ জানিয়েছে, জঙ্গি আশরাফুল একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার দেবীনগর ইউনিয়নের চর চাকলা গ্রামে। আর প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, সাজ্জাদ আলীর বড় ছেলে চাঁপাইনবাগঞ্জের চরাঞ্চলের একটি কওমী মাদ্রাসার ছাত্র। তারা ধারণা করছেন, সোয়েবের মাধ্যমেই জঙ্গি আশরাফুলের সংস্পর্ষে আসে পুরো পরিবারটি। এ জন্য বাড়ির নারীরা সব সময় পর্দা মেনে চললেও অভিযানের রাতে তাদের বাড়িতে ছিল বহিরাগত আশরাফুল।


গোদাগাড়ী থানার ওসি হিপজুর আলম মুন্সি বলেন, নিহত জঙ্গি আশরাফুল একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার ছিল। তথ্য-প্রযুক্তিতেও তার ভালো দখল ছিল। বোমা বানানোর কাজে এ ধরনের মেধাবীদেরই দলে টানে জঙ্গিরা। হয়তো অন্য কোনো মাধ্যমে সে আগে থেকেই জঙ্গিবাদে জড়িত ছিল।


ওসি বলেন, জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়ার পর এমনও হতে পারে সাজ্জাদের পুরো পরিবারটি আশরাফুলের মাধ্যমেই সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য হয়। নিহতরা সবাই জঙ্গি, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তারা প্রকৃতপক্ষে কোন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য তা পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি বলেও জানান ওসি। শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সাজ্জাদ আলীর বাড়িতে অপারেশন ‘সান ডেভিল’ চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় বাড়ি থেকে ১১টি বোমা, একটি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন ও দুই রাউন্ড গুলি। এ ছাড়া বাড়ি থেকে পুলিশের পোষাকের কাপড়, সুইসাইডাল ভেস্টের বেল্ট, গানপাউডার, বোমার সুইচ ও কিছু জিহাদী বইসহ নানা ধরনের আলামত জব্দ করা হয়েছে।


বিবার্তা/রিমন/নাজিম

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com