শিরোনাম
উৎসবের রঙ ছড়িয়ে এলো বৈশাখ
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০১৭, ০৫:১৩
উৎসবের রঙ ছড়িয়ে এলো বৈশাখ
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

কালের আবর্তে একটি বছর যায় হারিয়ে, আরেকটি বছর আসে। পহেলা বৈশাখের পরিচিত সেই রূপটি আবার ঘুরে আসে বাঙালির ঘরে নবআনন্দে, নবরূপে। ঢাকের তালে, পান্তা-ইলিশ খাওয়া, রঙ-বেরঙের মুখোশ পরা আর মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে আবার নতুন বছরকে বরণ করে নেয়া হয়। আবার বাঙালি তার নতুন বছরের শুভ কামনায় নতুন দ্বার উন্মোচন করে। এভাবেই নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। প্রকৃতির সবখানেই যেন নতুন সুর। উৎসবের রঙ ছড়িয়ে এসেছে পহেলা বৈশাখ। বাঙালির সার্বজনীন উৎসব আজ। বিশ্বজুড়ে বাঙালি আজ মেতে উঠবে আনন্দে-উচ্ছ্বাসে। ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষ একযোগে গাইবে, 'এসো হে বৈশাখ, এসো এসো'। সব গ্লানি মুছে নবোদ্যমে শুরু হবে পথচলা। স্বাগত ১৪২৪। শুভ নববর্ষ।


আজ প্রভাতে পূবাকাশে লাল টকটকে সূর্যের কিরণছটার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে নতুন বছর। উৎসবময় অনুভূতি সঙ্গী করে নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে বাঙালির।


বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব পহেলা বৈশাখ। নতুন করে যাত্রা শুরুর মুহূর্তে সবাই গেয়ে উঠবে, 'তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।'


অন্যান্যবারের মতো এবারও পহেলা বৈশাখের মূল আয়োজন হবে রমনা উদ্যানের অশ্বত্থমূলে, যা বটমূল হিসেবে পরিচিত। ছায়ানটের আয়োজনে প্রভাতি এ আয়োজনে সংগঠনটির প্রায় দেড়শ' শিল্পী গাইবেন মানবতার গান।


সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে, বিরাজ সত্য সুন্দর’ - এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য এই চরণটির আলোকেই গ্রহণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা বিবেচনা করে সকল অশুভের অন্ধকার দূর করে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আসুক বাংলা নতুন বছর।
তবে শোভাযাত্রার ফেস্টুন করা হয়েছে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন’ বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে। বিষয়টিকে সামনে রেখেই তৈরি হয়েছে মায়ের কোলে শিশু, সাম্পান, ক্ষ্যাপা ষাঁড়, একটি গাছে তিনটি পাখি। থাকছে হাতি, ঘোড়া আর হরিণও।


বৈশাখ উদযাপনের অনুসঙ্গ হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রা যুক্ত হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমে শোভাযাত্রার শিল্পকর্মগুলো তৈরি করছেন শিক্ষার্থীরা। একাজে পারিশ্রমিক নয়, সৃষ্টির আনন্দই তাদের কাছে মুখ্য।
শোভাযাত্রার খরচের বড় অংশটাই আসে মুখোশ বিক্রি থেকে। এবছর মুখোশ পরায় বিধি-নিষেধে সেই বিক্রিতে পড়েছে ভাটা।


বাংলা নববর্ষ শুরুর ইতিহাস
হিন্দুদের সৌর পঞ্জিকা অনুযায়ী বাংলা ১২টি মাস প্রাচীনকাল থেকেই পালিত হয়ে আসছে। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে। হিন্দুদের সৌর বছরের প্রথম দিন বঙ্গ, ত্রিপুরা, মনিপুর, উড়িষ্যা, আসাম, নেপাল, কেরল ও পাঞ্জাবের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই এই উৎসব পালিত হয়। নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ এক সময় ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। তখন এর মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষিকাজ। তখন কৃষকদের ঋতুর ওপরই নির্ভর করতে হতো। আর এজন্যই এটি মূলত ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। আর এখন পহেলা বৈশাখ নতুন বছরের সূচনার সর্বজনীন একটি উৎসব।


ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতেন, কিন্তু হিজরি সন চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে কৃষকদেরকে অসময়ে খাজনা পরিশোধ করতে হতো। মুঘল সম্রাট আকবর খাজনা আদায় সুন্দরভাবে করার লক্ষ্যে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনিই মূলত প্রাচীন বর্ষপুঞ্জিটি সংস্কার আনার আদেশ দেন। তাঁর আদেশমতেই তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি আরবি হিজরী সন ও সৌর সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকেই বাংলা সন গণনা শুরু করা হয়। তবে এই গণনাপদ্ধতি ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে কার্যকর করা হয়। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে এটি বাংলা বর্ষ বা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিতি লাভ করে।


বাঙালির আধুনিক নববর্ষ উদযাপন
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের প্রথম খবর পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরপর ১৯৩৮ সালেও একইরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এর পুনঃজাগরন করে। এভাবেই বাঙালির আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের শুরু হয়।


বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ
শহর ও গ্রাম - উভয় স্থানেই নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার উৎসব পালিত হয়। দেশীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টি এর মাধ্যমে ফুটে ওঠে। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়।


সাধারণত গ্রামাঞ্চলে নদীর ধারে কিংবা খোলা মাঠে এই উৎসব পালন করার জন্যে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। এভাবে সারা দেশেই উৎসবের আমেজে বাংলা বর্ষবরণ হয়। এদিন ঘরে ঘরে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়, নানারকম পিঠাপুলি তৈরি করা হয়।
নববর্ষে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত বাঙালির ঐতিহ্যের সাথে মিশে গেছে। শহুরে জীবনে পান্তা-ইলিশ ছাড়া যেন নববর্ষ অপূর্ণ থেকে যায়। আমাদের দেশে মূলত ঢাকার রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ ও মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমেই বর্ষবরণ উদযাপন শুরু হয়। ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ‘এসো হে বৈশাখ’ গান গেয়ে নতুন বর্ষকে বরণ করেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট এই রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। বটমূল বলে পরিচিত হলেও আসলে এটা একটা অশ্বথ বৃক্ষ। কিন্তু অনেককাল ধরে এটা মানুষের কাছে বটবৃক্ষ বলে পরিচিত।


মঙ্গল শোভাযাত্রা
ঢাকার নববর্ষ উৎসবের আবশ্যিক একটি অংশ হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রথমে আনন্দ শোভাযাত্রা নামে এর সূচনা হয়। পরে এটি মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম ধারণ করে। এটি এখন পহেলা বৈশাখের অন্যতম একটি আকর্ষণ।


শোভাযাত্রাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে ওখানেই শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় আবহমান গ্রামবাংলার চিরায়ত ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এই শোভাযাত্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন রঙ-বেরঙের মুখোশ পরে অংশগ্রহণ করে। এই দিনে যেন পাঞ্জাবি আর শাড়ি ছাড়া কাউকে কল্পনাই করা যায় না। রঙ-বেরঙের মুখোশ আর মুখে ফুলকি একে ছোট-বড় নানান বয়সী মানুষ এই দিনটিকে উৎসবের সঙ্গে পালন করে। ঢাক-ঢোলের আওয়াজ আর নানা গানের আয়োজনে এই দিনটি আরও উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।


রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশের সূচনা
১৯৮৩ সালে রমনা বটমূলে কয়েকজন সংস্কৃতিবান মানুষ প্রথম পান্তা-ইলিশের সূচনা করেন। তখন পান্তা-ইলিশের সাথে কাঁচামরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে এর আয়োজন করা হয়। এভাবেই রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশের সূচনা হয়, যা আমাদের বাঙালিয়ানার পরিচয় বহন করে। আর এখন তো এ পান্তা-ইলিশ ছাড়া নববর্ষ চিন্তাই করা যায় না।


হালখাতা অনুষ্ঠান
সম্রাট আকবরের সময় থেকেই ভারতবর্ষে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন সবাইকে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল প্রকার খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এ পর্যায়ে এসেছে। তখন এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে মূলত একটি নতুন হিসাববই বোঝানো হয়। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নতুন বছরের জন্যে সকল প্রকার হিসাব-নিকাশ নতুন করে শুরু করা যাবে। শহর কিংবা গ্রাম বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব-নিকাশের বই বন্ধ করে নতুন বছরের জন্যে হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিযে আপ্যায়ন করে থাকেন। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে। এই দিনে তারা নতুন হালখাতা খোলার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের ক্রেতাদের কাছ থেকে পাওনা টাকাও আদায় করে থাকেন।


বৈশাখি মেলা
বৈশাখ মানেই যেন মেলা। বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেলা শুরু হয়ে যায়। শহর কিংবা গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই মেলা শুরু হয়। কোনো কোনো জায়গায় বৈশাখী মেলা মাসব্যাপী হয়। এই মেলায় নানা প্রকারের দেশীয় মিষ্টান্ন, নারিকেল মুড়কিসহ আরও অনেক সুস্বাদু খাদ্যের দেখা মেলে। প্রতি বছর চট্টগ্রাম নগরীর লালদীঘির ময়দানে বসে ঐতিহাসিক জব্বারের বলি খেলা। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লাঠি খেলা, নৌকাবাইচ প্রভৃতি খেলা হয়।


বহির্বিশ্বে বাঙালির বর্ষবরণ
বাংলাদেশ ছাড়াও বহির্বিশ্বে যেখানেই বাঙালি আছে সেখানেই স্বল্প কিংবা বৃহৎ পরিসরে এই পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাঙালিরা নিজেদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে গান-বাজনা, ছবি, পোশাক-আশাকের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করে। আর এভাবেই বাইরে থেকেও বাঙালির জীবনে পহেলা বৈশাখ বেঁচে আছে।


বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com