ঢাবি ভাস্কর্যের নেপথ্যের ইতিহাস
প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৩, ১৮:৩০
ঢাবি ভাস্কর্যের নেপথ্যের ইতিহাস
ওমর ফারুক
প্রিন্ট অ-অ+

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)-এর বাংলাদেশ অভ্যুত্থানের পিছনে রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পূর্ব বাংলার আশা, আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। দেশের যে কোন ক্রান্তিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য।


ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সকল জাতীয় আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


যারা দেশমাতৃকার সম্মান-সম্ভ্রম রক্ষার্থে ও বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে শাহাদাত বরণ করেছেন, তাঁদের স্মরণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। প্রতিটি ভাস্কর্যের পেছনে রয়েছে একেকটি সংগ্রামের ইতিহাস। ভাস্কর্যগুলো নিছক জড়বস্তু নয় বরং ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক। এগুলো মাথা উঁচু করে বলছে অধিকারের কথা, ত্যাগের কথা। ভাস্কর্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভাস্কর্যের নেপথ্যের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-


অপরাজেয় বাংলা



সর্বস্তরের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের প্রতীক 'অপরাজেয় বাংলা'। তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধার এই অবক্ষ ভাস্কর্যটি স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলো- যে দিনগুলো ছিল বন্দিত্বের গ্লানি মুছে বাংলা মায়ের বক্ষবিদীর্ণকারী শত্রুদের মূলোৎপাটনের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে অবস্থিত এই ভাস্কর্য। এটি নির্মাণ করেন মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। অপরাজেয় বাংলা নামকরণটি করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। ভাস্কর্যটিতে তিনজনের মধ্যে একজন বলিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি- যার বাম হাতে গ্রেনেড এবং ডান হাত রাইফেলের বেল্ট ধরা। বাম দিকে রয়েছে হাতে রাইফেল ধরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র এবং ডান দিকে সেবার প্রতীক মুক্তিযোদ্ধা নারী- যার কাঁধে ঝুলছে প্রাথমিক চিকিৎসার একটি বাক্স। ১৯৭৩ সালে ভাস্কর্যটি তৈরি করা শুরু হয়। ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ‘অপরাজেয় বাংলা’ উদ্বোধন করা হয়। ৬ ফুট বেদীর উপর নির্মিত এর উচ্চতা ১২ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট ও ব্যাস ৬ ফুট। এই ভাস্কর্যটিতে মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।


স্বোপার্জিত স্বাধীনতা



‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ ভাস্কর শামীম শিকদার নির্মিত একটি ভাস্কর্য, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়কদ্বীপে অবস্থিত। ভাস্কর্যের পুরো গা-জুড়ে রয়েছে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের খণ্ডচিত্র। চৌকো বেদির ওপর মূল ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। উপরে বামে আছে মুক্তিযোদ্ধা কৃষক আর ডানে অস্ত্র হাতে দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাঝখানে অস্ত্র হাতে নারী ও পুরুষ যোদ্ধারা উড়িয়েছে বিজয় নিশান। কিন্তু পতাকা ওড়ানোর জন্য বাঙালি যে রক্ত দিয়েছে, সয়েছে নির্যাতন- তার ক'টি খণ্ডচিত্র বেদির চারপাশে চিত্রায়িত। এ ভাস্কর্য বেদির বাম পাশে আছে ছাত্র-জনতার ওপর অত্যাচারের নির্মম ইতিহাস। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এ ভাস্কর্য গড়া শেষ হয়।


রাজু ভাস্কর্য



অধিকার আর দাবি আদায়ের নির্ভরতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজু ভাস্কর্য। শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ যেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের অধিকারের কথা বলে। সন্ত্রাস বিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির সড়ক দ্বীপে অবস্থিত। ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের সন্ত্রাস বিরোধী মিছিল চলাকালে সন্ত্রাসীরা গুলি করলে মিছিলের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজু নিহত হয়। রাজুসহ সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনের সকল শহিদদের স্মরণে নির্মিত এই ভাস্কর্য ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ. কে. আজাদ চৌধুরী উদ্বোধন করেন। এই ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী ও সহযোগিতা করেছেন গোপাল পাল।


স্বাধীনতা সংগ্রাম



‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ভাস্কর্যটি বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাসকে ধারণ করে নির্মিত। ভাস্কর্যটি মহান ভাষা অন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৬-র ছয়দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান, ২৫ মার্চের কালরাত্রি, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন এমন ১৮ জন শহিদের মুখাবয়ব দিয়ে পুরো ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছে। সবার নিচে ভাষা শহিদদের ভাস্কর্য এবং সবার উপরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। এ ভাস্কর্যে আরো তুলে ধরা হয়েছে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার প্রতীক আমাদের লাল-সবুজের পতাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফুলার রোডে স্যার সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল ও বুয়েট সংলগ্ন সড়ক দ্বীপে বাংলাদেশের ইতিহাসের স্মারক স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যটি স্থাপিত। ১৯৮৮ সালে শিল্পী শামীম সিকদার ফুলার রোডে অবস্থিত সেকেলে বাংলো স্টাইলের বাড়ির (বর্তমানে প্রো-ভিসির বাসভবন) সামনের পরিত্যক্ত জায়গায় এই ভাস্কর্য নির্মাণ শুরু করেন। তখন এর নাম ছিল ‘অমর একুশে’।


স্মৃতি চিরন্তন



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে স্মৃতি চিরন্তন স্মৃতিফলকটি নির্মাণ করা হয় ১৯৯৫ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন এবং ফুলার রোডের অগ্রভাগে (ভিসি চত্বর নামে পরিচিত) স্মৃতি চিরন্তন অবস্থিত। কালো গ্রানাইটের ওপর নির্মিত স্মৃতি চিরন্তনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট ১৯৫ জন শহিদের নামাঙ্কিত রয়েছে। এটি নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন স্থপতি মহিউদ্দীন শাকের। পাক বাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ড, নিষ্ঠুর, অমানবিক নির্যাতনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে কংক্রিটের দেয়ালে বসানো পোড়ামাটির ফলকে। এটির দায়িত্বে ছিলেন শিল্পী রফিকুন্নবী এবং পোড়ামাটির ফলক তৈরি করেছেন আবু সাঈদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন, শিল্পী নিসার হোসেনের নেতৃত্বে ‘স্মৃতি চিরন্তন’ বর্তমান রূপ নেয় ২০১৫ সালে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের আহ্বায়ক কাজী রাকিব হোসাইন ছাত্রনেতা রাজু'র প্রতি সম্মান জানিয়ে বিবার্তাকে বলেন, পরিবেশ পরিষদ চুক্তি অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে অস্ত্রের ব্যবহার, সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচার ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ। এই চুক্তিটা স্বাক্ষরিত হয় মঈন হোসেন রাজুর শাহাদাত বরণের লক্ষ্যে। রাজু ভাস্কর্য যেহেতু সেন্ট্রাল পয়েন্টে অবস্থিত- এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠবে তা প্রত্যাশিত ছিল। বর্তমানে সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী রাজনৈতিক চর্চার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কেন্দ্র হয়ে উঠছে রাজু ভাস্কর্য।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুকুল কুমার বাড়ই বিবার্তাকে বলেন, জাতীয় জীবনের ঘটনাপ্রবাহে প্রতিটি ভাস্কর্য একেকটা স্মারক এবং ঐতিহাসিক বিষয়। জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য সচেতনতার অংশ। দেশের আপামর জনগণের উচিত প্রতিটি ভাস্কর্যের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে ভাবা এবং তাদের আদর্শকে জীবনে ধারণ করা।


বিবার্তা/ফারুক/রোমেল

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com