৫৩ জনকে অবৈধ পন্থায় নিয়োগ, ডিজিটাল যুগে এসে সিন্দুকে টাকা রেখে নগদ লেনদেন, পুরাতন কাগজপত্র বিক্রিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠকানোসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. বাহালুল হক চৌধুরী। যা নিয়ে গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আর এসবের দায়ে তাকে শোকজও করা হয়েছে। তবে এ শোকজ করার পর ৩ মাসের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কোন ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট মহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।
তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে নিয়োগ বিজ্ঞাপন ছাড়াই মৌখিক নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসে ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ৫৩ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন মো. বাহালুল হক চৌধুরী। অধিভুক্ত সাত কলেজের জরুরি কার্য সম্পাদনদের অজুহাত দেখিয়ে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্যে এসব নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান তাকে এ কাজে মৌখিকভাবে সম্মতি দিয়েছেন বলেও জানা যায়।
তথ্য বিশ্লেষণে আরও জানা যায়, অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগকৃত এসব জনবলের বেতন-ভাতা সংক্রান্ত কোন তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব পরিচালকের দফতরে ছিল না। এক্ষেত্রে রিসিট ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ থেকে টাকা এনে লামসাম বেতন দেয়া হয় এসব কর্মচারীদের। এদিকে খাতা বিক্রির টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ফান্ডে জমা না দিয়ে এবং সাত কলেজ থেকে টাকা সংগ্রহ করে সিন্দুকে রেখে নিজের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে থাকেন বাহালুল হক চৌধুরী। ডিজিটাল যুগে এসে তার এমন লেনদেনের ঘটনায় উঠেছিল নানা প্রশ্ন। শুধু তাই নয়, তার দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তে দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানটি পুরাতন কাগজপত্র বিক্রিতে ১৮ লাখ টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের এসব লাগামহীন অনিয়ম- দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ফলে নড়েচড়ে বসে ঢাবি প্রশাসন। পরে গত বছরের ১১ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রবীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে শোকজ নোটিশ দেয়া হয়। এই চিঠিতে তাকে পত্র ইস্যুর তারিখ হতে ৩ (তিন) কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শিয়ে লিখিতভাবে জবাব দিতে বলা হয়।
এদিকে ডিজিটাল যুগে সিন্দুকে লেনদেনের ঘটনায় তীব্র সমালোচনা শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত ভিন্ন এক চিঠিতে অধিভুক্ত ও উপাদানকল্প কলেজগুলো থেকে নগদে কোন ধরণের ফি না নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
এই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়,'পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের অফিস কর্তৃক পরীক্ষার এন্ট্রি ফরম বাবদ নগদে অর্থ গ্রহণের বিদ্যমান রেওয়াজ রহিত করা হলো।
এদিকে শোকজের চিঠির পর নিজের মনগড়া তথ্যে জবাব দিয়েছেন অভিযুক্ত বাহালুল হক চৌধুরী। এরপর থেকে নীরব অবস্থায় রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাবির একটি সূত্র বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. বাহালুল হক চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আস্থাভাজন ও বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের লোক হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। নানা দুর্নীতিতে জড়িত এই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কলঙ্কজনক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলে জানায় সূত্রটি।
নানা অনিয়মের দায়ে শোকজ চিঠি দেওয়ার পরেও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রবীর কুমার সরকার বিবার্তাকে বলেন, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র। আপনি এ বিষয়ে উপাচার্যের সাথে কথা বলতে পারেন।
দুর্নীতির দায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হলে সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো অনিয়মের খবর শুধু সংবাদ না, যেভাবে পাওয়া যাক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নলেজে তো আছেই। সংবাদ হওয়ার আগে তো বহু ঘটনা ঘটে। এটা তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিকার করা উচিত।
তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে যেটা মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনে যারা থাকেন অর্থাৎ ভিসি, প্রো ভিসি, ট্রেজারার তারা যদি খেয়াল রাখেন অথবা ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় না দেন, তখন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের খুব একটা কিছু করার সুযোগও নেই। আর এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের মধ্যেও নেই। কাজেই আমি মনে করি, যারা দায়িত্বে আছেন তাদের প্রশাসনিক কাজে যথাযথ মনোযোগ দেওয়া দরকার, সময় দেওয়া দরকার। সর্বোপরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন প্রশাসন সতর্ক থাকলে কর্মকর্তাদের অনিয়ম এড়ানো সম্ভব।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বিবার্তাকে বলেন, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যেহেতু অনিয়ম- দুর্নীতির দায়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে শোকজ করা হয়েছে, সেহেতু ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে বলে আমি মনে করি। কাজেই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এবং নাগরিক সমাজের মনে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করা আমাদের আশু কর্তব্য।
ঢাবির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, কাউকে শুধু নোটিশ দিলে হবে না। আমরা নিয়ম নীতি অনুযায়ী কাজ করি। কিছু অসৎ উদ্দেশ্যের লোক আছে যারা অনেক কিছু রটায়। এক্ষেত্রে কেউ অপরাধ করে থাকলে আমরা নিয়ম নীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি।
দুর্নীতির দায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন প্রশাসনের করণীয় সম্পর্কে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, কারো বিরুদ্ধে যদি কোন অভিযোগ আসে এবং সেগুলো যদি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে বিষয়গুলো পরীক্ষা -নিরীক্ষা করে যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন,ব্যক্তিগতভাবে যদি কেউ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করে সেটা যেমন তদন্ত করতে হয়,ঠিক একইভাবে গণমাধ্যমে আসার পর যখন একটা বিষয়কে সারা দেশের মানুষ জেনে যায়, তখন সেই বিষয়ের তদন্ত করে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। কারণ তা না হলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি হবে। কারণ, ঘটনা ঘটার পর জনগণ বলবে, এই ঘটনা ঘটেছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ কী করছে? কাজেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কর্তৃপক্ষের ভার্সন দরকার। আর এই ভার্সন আসবে কোথা থেকে? এটা তো তদন্তের ভিত্তিতে আসতে হবে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে দুর্নীতিগ্রস্ত এই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দুর্নীতির বিষয়ে এখনও তদন্ত করে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।
http://www.bbarta24.net/special-report/202103 ( ঢাবিতে মৌখিক নির্দেশে ৫৩ জনের নিয়োগ: ডিজিটাল যুগেও সিন্দুকে টাকা রেখে নগদ লেনদেন!)
https://www.bbarta24.net/special-report/202901 (পুরাতন কাগজ বিক্রেতা ঢাবির ১৮ লাখ টাকা ঠকিয়েছে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক!)
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]